
খেলোয়াড় পরিচয়ে তাঁদের চেনেন সবাই। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ঝটপট প্রশ্নোত্তর পর্বে সেটাই জানার চেষ্টা…
আজকের তারকা: রাসেল মাহমুদ জিমি
বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়াড়, নিজের সময়ের তো অবশ্যই সেরা। রেকর্ড ছয়টি এশিয়া কাপ খেলেছেন। বলা যায়, গত দুই দশকের বাংলাদেশের হকির মুখই হয়ে উঠেছেন রাসেল মাহমুদ জিমি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জহির উদ্দিন
কেমন যাচ্ছে দিনকাল?
রাসেল মাহমুদ জিমি: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। হকি নিয়েই আছি, খেলা না থাকলেও অনুশীলন করতে হয়। সারা বছরই আমাদের অনুশীলন চলে।
জীবনে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে কাকে বেশি মনে পড়ে?
জিমি: বাবাকে, তিনি ছিলেন ছায়ার মতো। এখন বুঝতে পারছি, বাবা থাকা কতটা দরকার। প্রতিটা পদক্ষেপে বাবার অভাব টের পাচ্ছি। আমার যেকোনো সমস্যায় বাবাকে সবার আগে পেতাম। ভালো খেললে বা মন্দ, সব সময় পাশে থাকতেন তিনি। তাঁকে খুব মিস করি।
বাবার কোনো পরামর্শ, যেটা এখনো মানেন?
জিমি: বাবা সব সময় বলতেন, নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো, যেন তোমার চেয়ে ওপরে যারা আছে, তারা তোমাকে নিয়ে টেনশন করে, আরা যারা নিচে আছে, তারা যেন তোমাকে নিয়ে হিংসা করে।
অবসর সময়ে কী করা হয়?
জিমি: ছুটি পেলে পরিবার বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে যাই। সাধারণত মাওয়াতে বেশি যাওয়া হয়। বন্ধুরা মিলে রিকশা করে মাওয়া ঘাটে যাই।
রিকশা কেন?
জিমি: রিকশাতেই বেশি ভালো লাগে। গ্রামীণ পরিবেশটা উপভোগ করা যায়। যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় বিরতি দিই। এই ধরেন কোথাও চা ভালো, কোথাও আবার মিষ্টি।
আপনার প্রিয় খাবার?
জিমি: মায়ের হাতের সব খাবারই প্রিয়। আগে তো মা রান্না করতেন। এখন বউ রান্না করে।
পুরান ঢাকার মানুষ নাকি বিরিয়ানি না খেয়ে থাকতে পারেন না। আপনিও কি তেমনই?
জিমি: না, পুরান ঢাকার হলেও আমি কিন্তু বিরিয়ানি পছন্দ করি না।
কেন?
জিমি: আমার দাদা ছিলেন পুরান ঢাকার নামকরা বাবুর্চি। বিয়ের অনুষ্ঠান হলে সবাই দাদাকে ডাকত। তখন অনেক বিরিয়ানি খেতাম, তাই এখন আর ভালো লাগে না। ছোটবেলায় দাদাকে রান্নায় সাহায্য করেছি। আমি কিশমিশ, বাদাম নিয়ে চলে যেতাম।
খেলাধুলায় আগ্রহ কি ছোটবেলা থেকেই?
জিমি: শৈশব থেকেই। আমি খেলার পাগল ছিলাম। স্কুল যদি ১১টায় ছুটি হতো, আমি বাসায় আসতাম বিকেল ৪টায়। এমনও সময় গেছে বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা, সারা দিন মাঠে মাঠে থাকতাম।
কোন মাঠে খেলতেন?
জিমি: আরমানিটোলা স্কুল মাঠ আর বাবুবাজারের সাবস্ট্যান মাঠেই থাকতাম। বেশির ভাগ সময় ফুটবল খেলতাম।
তাহলে ফুটবলার হলেন না কেন?
জিমি: ইচ্ছা ছিল ফুটবলার হওয়ার। কিন্তু রক্তে ছিল হকি, শেষ পর্যন্ত হকিই হলো জীবনের সব।
খেলার বাইরে জীবন কেমন, সিনেমা দেখা, গান শোনার সময় হয়?
জিমি: সিনেমা আগে দেখতাম। এখন খুব একটা দেখা হয় না। স্কুলে পড়ার সম প্রতি শুক্রবার টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখাত, ওগুলো খুব মন দিয়ে দেখতাম। ক্যাসেট ভাড়া করেও সিনেমা দেখতাম। আর পুরান ঢাকার মানুষ তো বাংলার চেয়ে হিন্দি গান বেশি পছন্দ করে। আমিও তেমনই।
প্রিয় গায়ক-গায়িকা কে?
জিমি: সেভাবে কেউ নেই। তবে মাইলসের গান ভালো লাগে।
প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী?
জিমি: অভিনেত্রী নেই, অভিনেতা শাহরুখ খান।
কোন ধরনের পোশাক পরতে বেশি পছন্দ করেন?
জিমি: জিনস প্যান্ট ও টি–শার্ট। পাঞ্জাবিটা কম পরা হয়।
জীবনে করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি, এমন কিছু কি আছে?
জিমি: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খুব শখ ছিল, পারিনি।
ছোটবেলায় ছাত্র হিসেবে কেমন ছিলেন?
জিমি: মোটামুটি, তবে পড়ালেখাকে খুব ভয় পেতাম।
কোন বিষয়টা বেশি কঠিন লাগত, আর সহজ লাগত কোনটা?
জিমি: কঠিন অঙ্ক আর সহজ বাংলা।
ধরুন, আপনি নিজের এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, প্রথম কোন কাজটা করবেন?
জিমি: কখনো যদি এমপি হই সবার আগে যানজট কমানোর চেষ্টা করব। এরপর এলাকাটা একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করব।
আর যদি কখনো হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হয়ে যান?
জিমি: আমি আমার ক্যারিয়ারে হকিতে যেসব সমস্যা দেখেছি, খেলোয়াড় হিসেবে যা যা অনুভব করেছি, সেগুলো সমাধান এবং বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব।
কখনো যদি লটারিতে অনেক টাকা পান কী করবেন?
জিমি: লটারি তো পাই না, আজ পর্যন্ত পাইনি। লটারির ভাগ্য ভালো না। তবে পেলে মনের অনেক ইচ্ছা আছে, সেগুলো পূরণ করব।
ইচ্ছাগুলো কী কী?
জিমি: ইচ্ছা তো অনেক। তবে সবার আগে গাড়ি কিনব। কারণ, গাড়ির প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে।
শ্বশুরবাড়ি থেকে যদি গাড়ি উপহার দেয়, নেবেন?
জিমি: না (হাসি)।
শৈশবের এমন কোনো স্মৃতি আছে, যেটা এখনো মনে পড়ে?
জিমি: অনেক স্মৃতি আছে। তবে নানাবাড়ির স্মৃতি প্রায়ই মনে পড়ে।
কী রকম স্মৃতি?
জিমি: তখন নানাবাড়ি যেতাম চুল নিয়ে, আসতাম চুল ছাড়া...নানি ধরে মাথা ন্যাড়া করে দিতেন। এভাবে মোটামুটি ন্যাড়া হওয়ার সেঞ্চুরি করেছি। একমাত্র নাতি ছিলাম, সে জন্য সবার আদরও পেতাম।
কখনো কারও প্রেমে পড়েছেন?
জিমি: হ্যাঁ, একজনের প্রেমে পড়েছিলাম। এখন সে আমার বউ। ১০ বছর প্রেম করেছি, তারপর বিয়ে। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের ১৯ বছরের সংসার।
প্রেমটা হয়েছিল কীভাবে?
জিমি: শুরুটা অপরিচিত নম্বর থেকে। তখন আমাদের বাসায় একটা নকিয়া ফোন ছিল। তার (বউয়ের) স্কুলে আমার এক আত্মীয় পড়তেন। তাকে দিয়ে প্রথমে ওর ফোন নম্বর জোগাড় করি। এরপর ফোন দিই। কিন্তু রং নম্বর বলে প্রথমেই ফোন কেটে দেয় সে। আমি হাল ছাড়িনি। ধীরে ধীরে পরিচয়। এভাবে শুরু।
তারপর, প্রেমটা এগিয়েছে কীভাবে?
জিমি: ওর বাসা আমাদের এলাকার পাশেই ছিল। এলাকার সবাইরে কিনে ফেলেছিলাম। রিকশাচালক থেকে শুরু করে তরকারির দোকানদার, দারোয়ান, কাজের বুয়া সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, গলিতে অপেক্ষা করতাম। ও যখন রাস্তা দিয়ে যেত, রিকশাওয়ালা বলে দিত কোথায় গেছে। আমি সেভাবে পাশের বাসার ছাদে গিয়ে উঠতাম। সেখান থেকে ওকে দেখতাম। ওদের বাসায় একটা টিঅ্যান্ডটি ফোন ছিল। সেখানে তিনটা মিসড কল দিতাম। তখন সে বুঝত আমি আসছি, বারান্দায় এসে দাঁড়াত।
হকি থেকে অবসরে যাওয়ার পর কী করবেন?
জিমি: কোচিংয়ে যেতে চাই। খেলায় যেমন ছিলাম, কোচিংয়েও আরও ভালো করার চেষ্টা থাকবে।
অনেক দেশ তো ঘুরলেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে কোনটা?
জিমি: সিঙ্গাপুরই বেশি ভালো লেগেছে। ওদের পরিবেশ এবং নিরাপত্তা খুব ভালো। রাত তিনটা হোক বা চারটা হোক, আপনি নিরাপদে গন্তব্যে যেতে পারবেন, মনের মধ্যে কোনো সন্দেহ বা ভয় থাকবে না। ছোট দেশ তো খুবই গোছানো তারা।
জীবনে কোনো আক্ষেপ আছে?
জিমি: না, সে রকম কোনো আক্ষেপ নেই। যাকে ভালোবেসেছি, তাকেই পেয়েছি। আমার একটা মেয়ে আছে, খুবই বাবাভক্ত। খেলাধুলায় ভালো করেছি, পরিবারের সব আশা পূরণ করতে পেরেছি। যতটুকু সম্ভব মা–বাবার জন্য করেছি। তবে একটা স্বপ্ন ছিল, যদি দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে পারতাম। এই আক্ষেপটা আছে।