কীভাবে করোনাভাইরাস দূর করা যাবে?
কাজটা কঠিন, কিন্তু দুঃসাধ্য নয়। হয়তো সময় লাগবে। কারণ, দেশের অন্তত ৬০–৭০ শতাংশ মানুষকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধক হতে হবে। এ জন্য টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। আমাদের দেশেও সুস্থ হয়ে ওঠা করোনা রোগীর রক্তরস (প্লাজমা) নিয়ে অন্যদের দেহে সেই রক্তরস দিয়ে তাকে রোগ প্রতিরোধী করে তোলার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ওদিকে আমেরিকায় একটি টিকা (ভ্যাকসিন) উদ্ভাবনের পথে। ওরা একটি আরএনএ ভ্যাকসিন, mRNA-1273, আবিষ্কারের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সফল হলে এবং আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএর অনুমোদন পেলেই ব্যাপক সংখ্যায় ভ্যাকসিনটি তৈরি করার কথা ওরা বলছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটি নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষায় সফলভাবে বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়েছে।
তবে মনে রাখতে হবে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও বাজারে আসতে সময় লাগবে। এ সময়টুকু আমরা কীভাবে পার করব, সেটাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
বিশ্ব অর্থনীতি এবং মানুষ যে ধরনের জীবনযাপন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সেটা তো দেড়–দুই বছর লকডাউনে রেখে চলা সম্ভব না। তাই আমাদের দেশে এবং আমেরিকা, ইতালি, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশই কিছু বিধিনিষেধের আওতায় পর্যায়ক্রমে লকডাউন শিথিলের ঘোষণা দিচ্ছে। এর ফলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়বে। আবার প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণ কম হবে। সংক্রমণ যতটা কম রাখা যায় সেটাই হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
আপাতত দরকার ওষুধ
আমরা হয়তো লক্ষ করেছি, করোনা রোগে শনাক্তদের মধ্যে সবাই যে মরণাপন্ন অবস্থায় চলে যাচ্ছে, তা নয়। বেশির ভাগ রোগীই শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠছেন। বিশ্ব পরিসরে করোনা–শনাক্তদের শতকরা ৬–৭ ভাগ রোগী মারা যান। আমাদের দেশে এই হার আরও কম দেড়–দুই শতাংশ। অর্থাৎ, প্রথমত লকডাউন শিথিল করা হলেও আমাদের খুব সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে। হয়তো এত দিনের জীবনযাপন প্রণালি বদলে ফেলতে হবে। যেমন, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যাব না। ভিড় এড়িয়ে চলব। বাইরে সব সময় মুখে মাস্ক পরব। চাকরির ধরন অনুযায়ী বাসায় বসে কাজ করার নতুন বিধিমালা তৈরি করব।
এখানে বলা দরকার, বাসায় থাকা মানে অন্ধকার ঘরে শুয়ে–বসে থাকা নয়। নিজেদের বাসাতেই যতটা সম্ভব দিনে কিছুক্ষণ শরীরে রোদ লাগানো দরকার। কয়েক দিন আগে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের ওপর বিশেষজ্ঞ, হার্ভার্ডের অধ্যাপক ড. ম্যানসনের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছে, রোদ পেলে ত্বক নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করতে পারে। এটা রক্তচাপ কমায় এবং হৃদ্রোগের আশঙ্কা দূর করে। তা ছাড়া ভিটামিন ডি তৈরিতেও সাহায্য করে, যা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। সুতরাং বাসায় থাকার সময়টুকুতে আমরা আরও বেশি আলো–বাতাসে থাকা ও শরীরচর্চা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি।
পাশাপাশি দরকার অন্তত আক্রান্ত হলে এর প্রতিকারে কার্যকর ওষুধ। এখন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। হয়তো শিগগিরই আমরা কার্যকর ওষুধ পাব। তখন আক্রান্ত হলেও মনের ভয় অনেকটাই কেটে যাবে। রোগের প্রতিষেধক দ্রুত আবিষ্কার এ জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অন্তত জানব যে আক্রান্ত হলেও সুচিকিৎসা আছে। এতে মনোবল অনেক বাড়বে।
তবে আবারও বলব, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, ভিড়ভাট্টায় না যাওয়া এবং মাস্ক পরে চলাফেরার কোনো বিকল্প নেই। করোনা–দিনের এটাই হবে নতুন জীবনযাপন প্রণালি।
সামাজিক সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির হার এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুর হার আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়তে পারে, যদি প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিতে ব্যর্থ হই। তাই সংক্রমণ কমানোর উপায়গুলো আমাদের ভালো করে মনে রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উপসর্গ না থাকলেও কোনো ব্যক্তি করোনা সংক্রমিত হতে পারে। তাই খুব সতর্ক থাকতে হবে। একটু গা ম্যাজম্যাজ করে। শ্বাস নিতে আগের মতো সহজ মনে হয় না। অথবা একটু যেন অন্য রকম লাগছে। এ অবস্থায় নিজ উদ্যোগে বাসায় ও কর্মক্ষেত্রে নিজেকে আলাদা রাখা দরকার। অন্তত ১৪ দিন পর্যন্ত লক্ষ রাখা, কোনো লক্ষণ দেখা গেলে চিকিৎসা নিতে হবে। তাহলে নিজেও বাঁচব, অন্যদেরও বাঁচাব।
এখানে সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা দরকার। কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন, তার মানে এই নয় যে তাঁকে ভয়ংকর কোনো রোগী হিসেবে চিহ্নিত করে সমাজচ্যুত করতে হবে। কারণ, সাধারণ ঠান্ডা–জ্বরও তো হতে পারে। সামান্য জ্বর বা কাশি অনেকেরই হয় এবং সাধারণ ওষুধেই সেরে যায়। তাহলে ভয়টা কিসের?
আমাদের উপার্জনের জন্য যেমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালিয়ে যেতে হবে, আবার করোনা রোগটা যেন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্যও প্রয়োজনীয় সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। এই দুইয়ের মধ্যে সঠিক সমন্বয় করে চলতে পারলে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি কম হবে আবার মহামারির ধকলটাও খুব জোরদার হতে পারবে না।
এখানেই হবে আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।
আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
quayum.abdul@prothomalo.com