
২০২১ সালে ২০ বছরের যুদ্ধে জয়লাভের পর আফগানিস্তানে সরকার গঠন করে তালেবান। কেউ কেউ একে তালেবানের দ্বিতীয় শাসন নামে অভিহিত করছেন। কেমন আছে নতুন আফগানিস্তান, তা দেশটিতে ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী। গত ৮ অক্টোবর আফগানিস্তানে যান তিনি, ফিরেছেন ৫ নভেম্বর। আফগানিস্তান ঘুরে তাঁর লেখা প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার ও অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ষষ্ঠ পর্বে থাকছে আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ‘আমর বিল মা’আরুফ, ওয়াননাহয়ি আনিল মুনকার’ (সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ)–এর মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম খাইবারের সাক্ষাৎকার। সাইফুল ইসলাম আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের তরুণ তালেবান মুজাহিদ। লড়াই করেছেন ২০ বছরের যুদ্ধে। জেলে গেছেন, অত্যাচারের শিকারও হয়েছেন।
আপনাদের মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো কোন কাজটা ভুল আর কোনটা ঠিক, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এখন কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, এ ব্যাপারে আপনারা সিদ্ধান্ত নেন কীভাবে?
সাইফুল ইসলাম: আমাদের যাবতীয় নিয়মকানুন পবিত্র কোরআন ও হাদিসে আছে। হত্যা করা, মদ্যপান বা সুদ নেওয়া—এসবই অন্যায়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে বোঝানো, যাতে তাঁরা এ ধরনের কাজ না করেন। বারবার বলার পরও কেউ করলে তাঁকে বিচারের আওতায় আনা আমাদের কাজ।
বারবার বলার পরও কেউ কথা না শুনলে আপনারা কী করেন?
সাইফুল ইসলাম: আমাদের নিজস্ব আইন আছে—৩৫টি (আইনের নামেই মন্ত্রণালয়ের নাম)। হিজাব করা, শরীর প্রদর্শন না করা, পুরো শরীর ঢেকে রাখা, সংগীত পরিহার করা, মাদক সেবন না করা ইত্যাদির বিষয়ে সেখানে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এখন কেউ যদি এগুলো পালন না করেন, তবে প্রথমে আমরা তাঁর সঙ্গে আলাপ করি। ওই ব্যক্তি কী ভুল করছেন, সে সম্পর্কে তাঁকে ধারণা দেওয়া হয়। সঠিক রাস্তা কী, তা-ও বলা হয়। তারপরও যদি তিনি কথা না শোনেন, তাহলে তাঁকে ‘তাজিরি কয়েদের’ (বিচারপতির ইচ্ছাধীন শাস্তি) জন্য পাঠানো হয়। বিচারপতি তখন তাঁকে এক-দুই ঘণ্টার জন্য হেফাজতে নেন। এরপরও যদি কথা না শোনেন, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করে তিন দিনের জন্য কারাগারে রাখা হয়। তারপর না শুধরালে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হয়।
আপনারা গ্রেপ্তার করতে পারেন?
সাইফুল ইসলাম: তৃতীয় পর্যায়ের পরে পারি। তবে সেটা পুলিশের সঙ্গে মিলে করা হয়।
আপনাদের অস্ত্রশস্ত্র আছে?
সাইফুল ইসলাম: না, আমাদের অস্ত্রশস্ত্র নেই।
মানে ‘আমর বিল মা’আরুফ, ওয়াননাহয়ি আনিল মুনকার’ একধরনের আইনের ভিত্তিতে শাসন করছে, আবার বিচার বিভাগের ভিন্ন আইন আছে।
সাইফুল ইসলাম: আইন একটাই—শরিয়াহ; যার ভিত্তি পবিত্র কোরআন ও হাদিস। এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ধরনের নীতি আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একধরনের নীতি, নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের আরেক ধরনের। তেমনি আমাদের মন্ত্রণালয়েরও নিজস্ব নীতি আছে।
কিন্তু আপনারা কি নিজেরাও গ্রেপ্তার করতে পারেন?
সাইফুল ইসলাম: কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পুলিশ বা আমার মন্ত্রণালয়ের নেই। অন্য দেশের মতোই এখানে চূড়ান্ত ফয়সালা করার অধিকার আদালতের। অনেকে বলেন, পুলিশ ও এই মন্ত্রণালয়ের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ হচ্ছে। কথাটা ঠিক নয়। দুটির কাজ আলাদা। মারধর, চুরি বা অন্যান্য অপরাধমূলক এবং নিরাপত্তার কাজকর্ম দেখার দায়িত্ব পুলিশের। নারী-পুরুষের অনৈতিক সম্পর্ক, নারীবিষয়ক বিভিন্ন বিষয়, হিজাব, সিনেমা দেখা, গান শোনা—এগুলো এই মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে পড়ে। তবে পুলিশের কেউ যদি কারও ওপর জুলুম করেন, তবে আমরা তাঁকে বিচারের জন্য আদালতের কাছে নিয়ে যেতে পারি।
গান শোনার ওপর আপনাদের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। চিত্রকর্ম বা ছবিতেও দেখলাম মুখগুলো মুছে দিয়েছেন। এর যুক্তি কী?
সাইফুল ইসলাম: শরিয়াহ অনুযায়ী ছবি তোলা হারাম। তবে এ বিষয়ে ইসলামি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে, ওলামাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন দেয়ালে লাগানো ছবি হারাম, আবার কেউ বলেন যে মুঠোফোনে তোলা ছবিও এর মধ্যে রয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, মুঠোফোনে তোলা ছবি এ নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত নয়। মুঠোফোন বা টেলিভিশনের ছবি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ কারণে মুঠোফোনের ছবির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি। আর সংগীতের কথা যদি বলেন, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে সংগীত সর্বত্রই হারাম।
এসব নিয়ে সিদ্ধান্ত কে নিচ্ছে?
সাইফুল ইসলাম: ইসলামি আমিরাত।
কিন্তু এসব খারাপ কেন?
সাইফুল ইসলাম: পবিত্র কোরআনে লেখা আছে। অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন যে হারাম, সে কারণে হারাম। এটা নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের নেই। বলা হয়েছে হারাম, তাই হারাম।
কিন্তু আমি আফগানিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম যে যানবাহনে গান বাজছে...
সাইফুল ইসলাম: এর অর্থ এই নয় যে এক জায়গায় সংগীত জায়েজ, অন্য জায়গায় নয়। কোনো জায়গাতেই বৈধ নয়। ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা যেতে পারে যে নয়াদিল্লিতে হয়তো কম চোর বা ডাকাত আছে, মুম্বাই বা কলকাতায় বেশি আছে। তার মানে কি এই যে কলকাতা বা মুম্বাইয়ে চুরি বা ডাকাতি জায়েজ? সব জায়গায় একইভাবে নিয়মকানুন মানা হয় না। আশা করা যেতে পারে যে ধীরে ধীরে নিয়ম মানা হবে এবং মানুষ ইসলামি আদবকায়দা মেনে চলবে।
নারীদের ক্ষেত্রেও দেখলাম যে অনেকে মুখ ঢাকছেন, আবার অনেক জায়গায় ঢাকছেন না। যেমন কান্দাহারে হয়তো ঢাকছেন, কিন্তু হেরাত বা কাবুলে ঢাকছেন না। এটাকে আপনারা কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
সাইফুল ইসলাম: একই ব্যাপার। কোথাও তাঁরা মুখ ঢাকছেন, আবার কোথাও ঢাকছেন না। এর ভিত্তিতে বলা যাবে না যে এক জায়গায় মুখ ঢাকা বৈধ, অপর জায়গায় অবৈধ। সব জায়গাতেই মুখ ঢাকা প্রয়োজন।
মেয়েদের ষষ্ঠ শ্রেণির পর সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ নেই। এ কারণে অনেকে একটা কথা বলেন, এই নারীরা যাঁরা এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন, যেমন স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষা; দশ-পনেরো বা বিশ বছর পর তাঁরা তো অবসর নেবেন; তখন শিক্ষাকেন্দ্র বা হাসপাতাল, যেখানে আফগানিস্তানের নারীরাই যাবেন, সেখানে তাঁদের চিকিৎসা কে করবেন? এর পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে আপনাদের চিন্তাভাবনা কী?
সাইফুল ইসলাম: এটি আমাদের মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিষয়।
কিন্তু এটা তো ঠিক যে আপনাদের মন্ত্রণালয় প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন এবং এ ধরনের বিষয়ে আপনারা আপনাদের মতামত প্রকাশ্যে বলেন।
সাইফুল ইসলাম: আফগানিস্তানে কিন্তু মেডিকেল কলেজ এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান খুলছে। কাবুল, হেরাত, কান্দাহার থেকে নানগারহারে খুলেছে।
মেয়েরা সেখানে যেতে পারেন?
সাইফুল ইসলাম: নিশ্চয়ই পারেন এবং অনেকে যাচ্ছেন। একেকটি মেডিকেল কলেজে কমপক্ষে ১ হাজার ৮০০ মেয়ে পড়াশোনা করতে পারেন।
কিন্তু এটা হয়তো আগে থেকেই আছে। কারণ, ষষ্ঠ শ্রেণির পর তো মেয়েরা চার বছর ধরে পড়তে পারছে না। ষষ্ঠ শ্রেণির পর যদি তারা পড়তে না–ই পারে, তাহলে মেডিকেল কলেজে যাচ্ছে কীভাবে?
সাইফুল ইসলাম: এখনো তো অনেক সময় বাকি আছে। ৫০ বছর লাগবে যেসব নারী কর্মক্ষেত্রে আছেন, তাঁদের অবসর নিতে। ৫০ বছর পর বিষয়টা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন হবে। নারীদের জন্য তো এখন পর্যাপ্ত নারী চিকিৎসক রয়েছেন।
মানে আপনি বলছেন, যখন আপনারা নারী চিকিৎসক পাবেন না, তখন নারীদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেবে না।
সাইফুল ইসলাম: কোনো অবস্থাতেই এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
কিন্তু মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়ার বিষয়টা তো আপনাদের তার আগেই ভাবতে হবে, না হলে তো চিকিৎসক বা শিক্ষিকা কম পড়ে যাবে।
সাইফুল ইসলাম: এটা হতেই পারে যে এ বছর বা আগামী বছর কোনো একটা পরিকল্পনা সামনে আসবে। হয়তো এমন কোনো আইন নিয়ে আসা হবে, যার ফলে সব স্কুল খুলে যাবে, ইনশা আল্লাহ।
আপনি বলছেন স্কুল খোলার সম্ভাবনা আছে?
সাইফুল ইসলাম: দেখুন, ব্যাপারটা এ রকম নয় যে পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটা একধরনের সাময়িক বিরতিতে আছে। বিষয়টা এ রকম নয় যে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে কেউ স্কুলে যেতে পারবে না বা মেয়েরা যেতে পারবে না। এটা ঠিক নয়। হয়তো এক মাস পর (স্কুল) খুলে যাবে, হয়তো এক বছর পর খুলবে বা দুই বছর পর। কিন্তু খুলবে।
আমি এমন একটা কথা শুনলাম যে আপনার মন্ত্রণালয় নাকি আট হাজার নারীকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। বিষয়টা কী?
সাইফুল ইসলাম: ঠিকই শুনেছেন। আমরা প্রায় আট হাজার নারীকে বিয়ে করতে সাহায্য করেছি। ইসলামে বিয়ের সময় যেমন একজন পুরুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি কাকে বিয়ে করবেন, তেমনি নারীদেরও একই অধিকার দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, একজন নারী যাঁকে পছন্দ করবেন, তাঁকে তিনি বিয়ে করতে পারবেন। এটা আমরা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া বিয়ের সময় একজন নারীকে যে দেনমোহর দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে তাঁর পরিবারের পুরুষেরা সেই অর্থ নিয়ে নিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এটা বন্ধ করতে পেরেছি। অসংখ্য নারী তাঁদের অধিকার আদায় করতে পেরেছেন। বস্তুত, আমাদের হিসাবে গত চার বছরে ৬০ হাজারের মতো নারীকে বিয়েসহ বিভিন্ন অধিকার আদায়ে সহায়তা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের শক্তি-সমর্থিত শাসনামলে এটা হয়নি।
সেটা কি আপনাদের মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে হয়েছে? কারণ, সমাজেই তো দেনমোহর দেওয়ার বন্দোবস্ত রয়েছে। এটা তো একটা নিয়ম। এখানে আপনাদের ভূমিকা কোথায়?
সাইফুল ইসলাম: বিয়েতে নারীদের যে দেনমোহরের অধিকার, তা অনেকেই পেতেন না। অনেক সময় কনের বাবারাই বরপক্ষ থেকে পাওয়া দেনমোহর মেয়েকে দিতেন না। টাকাটা নিজের কাছে রাখতেন। এমন পরিস্থিতির শিকার হওয়া নারীরা আমাদের কাছে এসে অভিযোগ করতেন। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এর ফয়সালা করেছি।
মানে আপনি বলছেন যে স্বামী দেনমোহর দিচ্ছেন, কিন্তু কনের বাবা তা নিয়ে নিচ্ছেন?
সাইফুল ইসলাম: হ্যাঁ, শুধু বাবা নন, ভাই-চাচারাও। আরও একটা ব্যাপার আছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ে নির্ভয়ে সাধারণ মানুষ তাঁদের অভিযোগ নিয়ে আসতে পারেন। আমরা সে অভিযোগ শুনে অত্যন্ত দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এখানে বলা দরকার, যেকোনো মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ বা গভর্নর—তিনি যে–ই হোন না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
কী ধরনের ব্যবস্থা?
সাইফুল ইসলাম: আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করি। বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ দেখার জন্য বিভিন্ন দপ্তর আছে।
শেষ পর্যন্ত কি দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়?
সাইফুল ইসলাম: অবশ্যই। আমরা আজই (২৩ অক্টোবর) একজন জিডিআই (জেনারেল ডিরেক্টরেট অব ইন্টেলিজেন্স) কর্মকর্তা, একজন গোয়েন্দা দপ্তরের কর্মকর্তা এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছি। তাঁদের এখন আমরা আদালতে পাঠাব।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সাইফুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।