
২০২১ সালে ২০ বছরের যুদ্ধে জয়লাভের পর তালেবান আফগানিস্তানে সরকার গঠন করে। কেউ কেউ একে দ্বিতীয় তালেবানের শাসন নামে অভিহিত করছে। কেমন আছে নতুন আফগানিস্তান, তা দেশটিতে ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী। তিনি গত ৮ অক্টোবর আফগানিস্তানে যান। ফিরেছেন ৫ নভেম্বর। আফগানিস্তান ঘুরে তাঁর লেখা প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার ও অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানের সীমান্ত প্রদেশ খোস্তের মানুষের এই মুহূর্তে নানা প্রশ্ন। তাঁদের প্রশ্নের কেন্দ্রে রয়েছেন একজন আফগান শরণার্থী—রহমানুল্লা লাকানয়াল। বলা হচ্ছে, খোস্তের লাকান জেলার বাসিন্দা রহমানুল্লা লাকানয়াল ওয়াশিংটনে দুই নিরাপত্তাকর্মীর ওপরে ২৬ নভেম্বর গুলি চালান। মৃত্যু হয় একজনের, আহত আরেকজন। আহত অবস্থায় হাসপাতালের বিছানা থেকে রহমানুল্লা লাকানয়াল জানিয়েছেন তিনি নির্দোষ।
কিন্তু মানুষ উদ্বিগ্ন। এর নানা কারণ আছে বলে মনে করেন খোস্ত শহরের বাসিন্দা এবং প্রদেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় শেখ জায়েদ ইউনিভার্সিটির ছাত্র আহসান উল্লাহ। আফগানিস্তানে আমার হোটেলে পরিচয় হয় আহসানের সঙ্গে। বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে গড়পড়তা আফগানের থেকে অনেক বেশি জানেন আহসান।
ওয়াশিংটনের ঘটনার কী প্রভাব খোস্তের ওপরে পড়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আহসান ডিসেম্বরের গোড়ায় ফোনে বললেন, ‘একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি। যে লোকটা (লাকানয়াল) গুলি চালাল, আমেরিকাই তাঁকে আফগানিস্তানে মানুষকে হত্যা করার প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। এখন সে আমেরিকার রক্ষীদেরই মেরে বসল।’
আহসানের কথায়, এর ফলে বিপদে পড়ল সেই সব আফগান শরণার্থী, যাঁরা আমেরিকা বা ইউরোপে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের যেকোনো সময় ফেরত পাঠানো হতে পারে। তিনি আরও বললেন, ‘একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে আমেরিকা যদি পেশাদার হত্যাকারী তৈরি না করত তাহলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। ফলে সব মিলিয়ে আফগানরা বিভ্রান্ত, একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি।’
হিংসা অবশ্য আফগানিস্তানে বিশ বছরের যুদ্ধের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে, যা তালেবানের পক্ষেই যায়। ওয়াশিংটনে গুলি চললে যেমন বিষয়টি তালেবানের পক্ষের আখ্যান হিসেবে দাঁড় করানো যায়, পাকিস্তান কাবুলের ওপরে বোমা ফেললেও তেমনই যায়। এটা বুঝেছে নতুন তালেবান।
এটা স্পষ্ট যে নতুন তালেবান অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক দলের মতোই যেকোনো হিংসার ঘটনা নিয়ে একটা ‘ন্যারেটিভ’ বা আখ্যান নির্মাণের গুরুত্ব বুঝেছে।
অতীতের মুজাহিদরা বুঝেছেন, যুদ্ধের বা হিংসার স্মৃতি ফিরলে বা যুদ্ধ শুরু হলে তাঁদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠান–বিরোধিতার হাওয়া গতি হারায়। তাই তাঁরা বারবার বলছেন, ওয়াশিংটনের ঘটনার জন্য আদতে দায়ী আমেরিকাই। এমনকি তালেবান-বিরোধীদেরও অনেকটা সেই মত। তালেবানের অন্যতম সমালোচক এবং সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও সাবেক উপরাষ্ট্রপতি আমরুল্লাহ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, লাকানয়ালের মতো মানুষের এ পর্যন্ত আসার ক্ষেত্রে দায় আমেরিকার।
ফলে এটা স্পষ্ট যে নতুন তালেবান অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক দলের মতোই যেকোনো হিংসার ঘটনা নিয়ে একটা ‘ন্যারেটিভ’ বা আখ্যান নির্মাণের গুরুত্ব বুঝেছে। এটাকে তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বা বৈশিষ্ট্য বলে মনে করছেন অনেকে।
পশ্চিম কাবুলের একটি অভিজাত পাড়া ফাহিম সুলতানি। রাস্তাঘাট, দোকান বা বাড়ির স্থাপত্যের সঙ্গে ঢাকার বড়লোক পাড়া গুলশানের মিল লক্ষণীয়। ক্যাফে, বিদেশি ঠান্ডা পানীয়, টিনবন্দী জমানো মাছ বা মাংসের দোকান থেকে রেস্তোরাঁর চেহারা বলে দিচ্ছে যে ফাহিম সুলতানি সাধারণের পাড়া নয়। আমি ও আমার এক সঙ্গী হেঁটে একটি বাড়ি খুঁজছিলাম।
আমার সঙ্গী জানালেন, ফাহিম সুলতানিসহ পশ্চিম কাবুলের অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছেন হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। আমরা যে বাড়িতে প্রবেশ করলাম, সেই বাড়ির কর্তা সমাজবিজ্ঞানী ফয়েজ জালান্দও বললেন সে কথা, তার সঙ্গে আরও একটা তথ্য জুড়ে দিলেন।
হাজারা বা তাজিকদের সঙ্গে তালেবানের লড়াইয়ের ইতিহাস দীর্ঘ। এর প্রধান কারণ তালেবান প্রধানত পাঠান। আফগানিস্তানে পাঠানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ...অন্য দেশের মতোই—সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘুর সম্পর্কের সমীকরণ মেনে।
জালান্দ বললেন, ‘বছর দশ-পনেরো আগে যখন আমি এই অঞ্চলে আসি, তখন এখানে তুমুল লড়াই চলছে, তালেবানের সঙ্গে হাজারাদের। অথচ এখন সব শান্ত।’ তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
হাজারা বা তাজিকদের সঙ্গে তালেবানের লড়াইয়ের ইতিহাস দীর্ঘ। এর প্রধান কারণ তালেবান প্রধানত পাঠান। আফগানিস্তানে পাঠানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সংখ্যালঘু হাজারা, তাজিক বা উজবেকদের সঙ্গে তাঁদের লড়াই চলছে অন্য দেশের মতোই—সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘুর সম্পর্কের সমীকরণ মেনে।
অন্তত দশ ফুট উঁচু প্রাচীরওয়ালা বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়ার সময় অধ্যাপক জালান্দ আমাদের বললেন, ‘কিন্তু এই তালেবানের একটা কৃতিত্ব যে হাজারাদের সঙ্গে কাজ চালানোর মতো মোটামুটি একটা সম্পর্ক তারা স্থাপন করতে পেরেছে, যে কারণে ফাহিম সুলতানিসহ কাবুলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লড়াই থেমে গেছে।’ একটু পেছনে হাঁটতে হাঁটতে আমার সঙ্গী ও অনুবাদক, যিনি একজন হাজারা, অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘লড়াই তো থামবেই! যারা লড়াই করত, আত্মঘাতী হামলা চালাত, তারাই তো দেশ চালাচ্ছে।’ আমি ভাবলাম, কথায় সত্যতা আছে।
লড়াই থামানোর জন্য তালেবানের প্রশংসা করলেও অধ্যাপক জালান্দ কিন্তু তালেবান-নিয়ন্ত্রিত ইসলামি আমিরাতের সমর্থক নন বরং কট্টর সমালোচক। কিন্তু তাঁর মতো সমালোচককে রাজধানীর একেবারে কেন্দ্রে বসে তাদের সমালোচনা করার স্বাধীনতা কেন দিচ্ছে তালেবান? বিশেষত যখন গোটা দুনিয়া মনে করছে চরম অসহিষ্ণু একটা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করতে উঠেপড়ে লেগেছে মুজাহিদরা। প্রশ্নের উত্তরে আবারও তালেবানের প্রশংসা করতে হলো অধ্যাপক জালান্দকে।
তালেবানবিরোধী হামিদ কারজাই নিজেও কাবুলে থাকেন, তাঁকে দেখে তাঁর মন্ত্রিসভা এবং আমলা পরিষদের সদস্যদের অনেকেই থাকেন।
প্রশস্ত বসার ঘরে আফগানি কাহয়ায় চুমুক দিয়ে অধ্যাপক জালান্দ বললেন, ‘এটা মানতেই হবে যে এটাও এই নতুন তালেবানের একটা বৈশিষ্ট্য।’ বললেন, ‘আমার বাসার ডান দিকের বাড়িটা ফারুক ওয়ার্দাকের। তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন রাজনৈতিক নেতা, হামিদ কারজাই মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী। কারজাইয়ের “চিফ অব স্টাফ”ও ছিলেন। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলেন, কিন্তু ফিরে আসেন। কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শুনিনি।’
বস্তুত তালেবানবিরোধী হামিদ কারজাই নিজেও কাবুলে থাকেন, তাঁকে দেখে তাঁর মন্ত্রিসভা এবং আমলা পরিষদের সদস্যদের অনেকেই থাকেন। উল্লেখ্য, প্রথম তালেবান কাবুল দখলের পরে ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ নাজিবুল্লাকে মেরে কাবুলের কেন্দ্রীয় অঞ্চল আর্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও তাঁকে কে মেরেছিল তা নিয়ে আফগানিস্তানে বিতর্ক অব্যাহত।
এবারে সে রকম কিছুই তালেবান করেনি বলে জানালেন অধ্যাপক জালান্দ। বললেন, ‘আফগানিস্তানের বৃহত্তম ইস্পাত কারখানা খান স্টিলের মালিক খান মোহাম্মদ ওয়ার্দাক থাকেন রাস্তার ওপারে। তিনিও তালেবান আসার পরে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে এসেছেন, ভালোভাবেই আছেন।’
তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের সঙ্গে তাদের বেশ কয়েক মাস আলাপ-আলোচনা হয়েছিল দোহায়। সেই আলোচনায় আফগানিস্তানের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ছিলেন ফয়েজ জালান্দ। তাঁদের প্রস্তাবে তালেবান যে খুব একটা আমল দিয়েছিল এমনটা নয়। অধ্যাপক জালান্দের ধারণা হয়েছিল, দেশে থাকতে অসুবিধা হবে। হয়নি। তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল তালেবানই।
ফলে তালেবান তাদের বিরোধীদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বা জেলে ভরেছে—এ কথা তিনি মানতে পারবেন না বলে মন্তব্য করে ফয়েজ জালান্দ বললেন, ‘আমাকে তারা এও বলে যে আমি নিশ্চিন্তে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে পারব। চার বছর ধরে তা–ই করছি, তার আগের দশ বছর ধরে যেমন করেছিলাম।’
তবে সবার ক্ষেত্রে এ কথা সত্যি নয়। যেমন এক তাজিক পরিবারের সঙ্গে আলাপ হলো, যাদের পরিবারের প্রধান পূর্ববর্তী সরকারের আমলে একটি প্রদেশে গোয়েন্দা দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন। নাম বা প্রদেশ গোপন রাখার শর্তে সেই অফিসারের এক কন্যা বললেন, তাঁর বাবাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। এক সাবেক সংসদ সদস্য এবং গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের দল হিজ্ব-ই-ইসলামির কমান্ডার আল্লা গুল মুজাহিদসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অধ্যাপক জালান্দ বললেন, আল্লা গুলের বিরুদ্ধে তাঁর অঞ্চলে সাধারণ মানুষের বিস্তর ফৌজদারি অভিযোগ ছিল। সে জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্তার বিষয়টি তিনি জানেন না।
তালেবান এমন অনেক কাজ এবার করেছে, যাতে সংবেদনশীলতার ছাপ স্পষ্ট।অধ্যাপক ফয়েজ জালান্দ, কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক জালান্দ বললেন, ‘কিছু এসব ব্যতিক্রম। তালেবান তাদের বিরোধীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটা “জেনারেল অ্যামনেস্টি” দিয়েছে। এমনকি পূর্ববর্তী সরকারের মন্ত্রী, পুলিশ অফিসার, আমলা—এঁদের ফেরানোর জন্য একটা কমিশনও তালেবান গঠন করেছিল, যাতে তাঁরা নিশ্চিন্তে এবং নির্ভয়ে দেশে ফিরতে পারেন। তাঁদের যাবতীয় প্রটোকল দেওয়া হয়েছিল, ভিআইপি বন্দোবস্ত হয়েছিল। এখনো নিরাপত্তার জন্য গুলিরোধক গাড়ি তাঁদের রয়েছে, নিরাপত্তারক্ষী দেওয়া হয়েছে, সম্প্রতি শুনলাম তাঁদের একটা মাসোহারাও দেওয়া হচ্ছে।’
এমনকি বিশেষ এক আদালত বানানো হয়েছে, যাতে পূর্ববর্তী সরকারের এই সব মন্ত্রী-আমলাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের শুনানি গোপনে করা যায়। এই অধ্যাপকের বক্তব্য, ‘প্রকাশ্যে শুনানি করে তাদের বিপদ বাড়াতে চায়নি তালেবান। তারা এমন অনেক কাজ এবার করেছে, যাতে সংবেদনশীলতার ছাপ স্পষ্ট।’
অধ্যাপক জালান্দের বসার ঘরে ঢুকতেই ডান হাতে প্রথম ছবিটি উপমহাদেশের অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি খান আবদুল গাফফার খানের। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি পাঠান জাতিসত্তার চরিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে যে আন্দোলন বিশ শতকে গড়ে উঠেছিল তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আবদুল গাফফার খান।
পাঠান জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে পছন্দ করলেও, তালেবান করে না। এর কারণ, তালেবান ইসলামি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, পাঠান জাতীয়তাবাদে নয়। এই সময় আফগানিস্তানে বসার ঘরে খান আবদুল গাফফার খানের ছবি রাখাটা যে বিপজ্জনক, তা স্বীকার করলেন অধ্যাপক জালান্দ।
‘তালেবান এখানে এলে এ কথা বলে বটে। গাফফার খানের ছবি দেখে তারা বিস্মিতই হয়। কিন্তু কী করা যাবে? সবকিছু তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না,’ অট্টহাস্য সহযোগে বললেন অধ্যাপক। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এক বন্ধুর ফোন নম্বর দিলেন তালেবানের কূটনৈতিক সাফল্য নিয়ে কথাবার্তা বলার জন্য। তাঁর ওই বন্ধু আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তা।
আফগানিস্তানে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার বড় সমস্যা হলো, ঘোরাফেরার জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে বারবার অনুমতি নিতে যাওয়া। এই দপ্তরের একটা হলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রতিবারই সেখানে ঢোকার সময় ছয় থেকে আটবার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান তালেবান রক্ষীরা। বছর পাঁচেক আগেও তাঁরা ছিলেন মুজাহিদ, তাঁদের ডিউটি পড়ত খাড়া পর্বতশৃঙ্গে, গভীর গিরিখাতে, মরুভূমির প্রান্তে।
এখন তাঁরা পেশাদারি দক্ষতায় অতিথির দেহে তল্লাশি চালান, ব্যাগ থেকে চার্জার বের করে অফিসে জমা রাখেন এবং কাগজপত্র চোখ বোলাতে বোলাতে জানতে চান শাহরুখ খান, সালমান খান, সানি দেওল আর অমিতাভ বচ্চন আজকাল কী করছেন। তাঁরা সবাই হিন্দি সিনেমার ভক্ত। অনেকেই বললেন, যুদ্ধ চলাকালীন গোপনে হিন্দি সিনেমা দেখতেন, গুহায় বসে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তাঁদের কেউ কেউ ওসামা বিন লাদেনকে দেখেছেন, কেউ বা মোল্লা ওমরের দেহরক্ষী ছিলেন। বর্তমানে কাবুলে চাকরির ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার চেষ্টা করছেন মুজাহিদরা।
এ ধরনের আরও এক দফা তত্ত্ব-তালাশের পরে অধ্যাপক জালান্দের বন্ধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে কর্মকর্তার ঘরে গেলাম তিনি নিরাশ করলেন। নিখুঁত ইংরেজিতে বললেন তিনি, যা বলবেন তা লেখা যাবে না, রেকর্ড করা যাবে না, তাঁর নাম দেওয়া তো দূরস্থান। ২০২১ সালের দ্বিতীয় তালেবানে যেমন ইসলামপন্থী মাওলানাদের সংখ্যা কম নয়, তেমনই কম নয় ইউরোপ-আমেরিকার ডিগ্রিধারী আপাদমস্তক সাহেব অফিসারদের সংখ্যাও। সাংবাদিকদের অনেকেই বললেন, প্রথম তালেবানে এই ধরনের কর্মকর্তা ছিলেন না।
জালান্দের বন্ধু কর্মকর্তা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটাই কথা বললেন। অতীতের তালেবানের সঙ্গে এই তালেবানের বড় ফারাক হলো যে তারা পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চায়, এমনকি আমেরিকার সঙ্গেও। আরও বললেন, ‘যতক্ষণ কোনো দেশ বন্ধুত্বের হাত বাড়াবে, যেমন চীন, রাশিয়া বা ভারত বাড়িয়েছে, ততক্ষণ সেই হাত ধরতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। এমনকি আমেরিকা বা পাকিস্তানের সঙ্গে আদান-প্রদান বাড়াতে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আপত্তি নেই। নিরাপত্তার প্রশ্নে তো পাকিস্তান একটা বড় ভূমিকা রাখতেই পারে। কিন্তু যদি সেই পথে না হেঁটে তারা বলে যে এখানে নতুন করে তাদের সেনাবাহিনী ঢোকাবে বা রাতারাতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, তবে সেটাকে আমরা কূটনীতি দিয়েই প্রাথমিকভাবে রোখার চেষ্টা করব।’
ওই কর্মকর্তা স্বীকার করলেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে তালেবান এবারে গোড়া থেকে যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, তা অতীতের থেকে অনেকটাই আলাদা। আফগানিস্তানে বাংলাদেশের দূতাবাস খোলার বিষয়েও তাঁরা আগ্রহী বলে জানালেন ওই কর্মকর্তা।
এভাবে অতীতের থেকে অনেক কিছুই অনেকটাই আলাদা বর্তমানের আফগানিস্তানে। যেমন করব্যবস্থা। নতুন তালেবান একটা কর–কাঠামো তৈরি করেছে এবং নিয়মিত বাণিজ্য কর আদায়ের মাধ্যমে মৌলিক পরিকাঠামোর কাজ করছে। যেমন রাস্তাঘাট তৈরি ও মেরামত, বড় নদী থেকে খাল কেটে চাষের জমিতে নিয়ে যাওয়া থেকে মাদকাসক্ত ও ভিক্ষুকদের ভাতা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা থেকে সামগ্রিক শান্তি স্থাপন—এমন অনেক কিছুই তারা করেছে, যা চার বছরে করাটা সহজ নয়। চট করে খনিজ সম্পদ দেশের বাইরেও যেতে দিচ্ছে না ইসলামি আমিরাতের সরকার। তাদের নীতির সঙ্গে না মেলায় বন্ধুদেশ চীনের তেল উত্তোলনের একটি প্রকল্পও তারা খারিজ করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ বারবারই বলেছেন, দুর্নীতি অনেকটাই কমেছে। ‘এসব কি সাফল্য নয়?’ প্রশ্ন পররাষ্ট্রমন্ত্রকের অফিসারের।
বলতেই হলো যে এ সবই সাফল্য। কিন্তু তার সঙ্গে বেশ কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। সেসব নিয়ে আলোচনা থাকবে পরের পর্বগুলোতে।