আফগানিস্তানে মেয়েরা একা ঘরের বাইরে বের হন না, এ কথা ঠিক নয়
আফগানিস্তানে মেয়েরা একা ঘরের বাইরে বের হন না, এ কথা ঠিক নয়

কেমন আছে আফগানিস্তান-৫

কেমন আছেন আফগানিস্তানের নারীরা

২০২১ সালে ২০ বছরের যুদ্ধে জয়লাভের পর আফগানিস্তানে সরকার গঠন করে তালেবান। কেউ কেউ একে ‘দ্বিতীয় তালেবানের শাসন’ নামে অভিহিত করছে। কেমন আছে নতুন আফগানিস্তান, তা দেশটিতে ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী। তিনি গত ৮ অক্টোবর আফগানিস্তানে যান। ফিরেছেন ৫ নভেম্বর। আফগানিস্তান ঘুরে তাঁর লেখা প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার ও অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ থাকছে পঞ্চম পর্ব

মাত্র কয়েক দিন বাকি। ডিসেম্বর মাস পেরোলে আর স্কুলে যেতে পারবে না ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া আয়েশা। কারণ, আফগানিস্তানে এখন ষষ্ঠ শ্রেণির পর সাধারণ স্কুলে যাওয়ার অনুমতি নেই মেয়েদের। এ নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মা শাকিনা আদিল। ধরা গলায় ৪৫ বছর বয়সী এই মা বললেন, ‘আয়েশা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। ওর তিন ভাই স্কুলে যাবে। কিন্তু সে বসে থাকবে বাড়িতে।’

২০২১ সালে আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে তালেবান। সে বছরই ষষ্ঠ শ্রেণির পর মেয়েদের সাধারণ স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তারা যদি একান্তই চায়, তবে যেতে হবে মাদ্রাসায়—শুধু ধর্মীয় শিক্ষার জন্য। এত দিন তারা ভূগোল, বিজ্ঞান, ইংরেজি বা গণিত, যা কিছু পড়েছে, তা আর সামনে এগোবে না। আর বন্ধু বিচ্ছেদের বিষয়টি তো রয়েছেই।

আয়েশার সহপাঠীদের অনেকেই মাদ্রাসায় যাবে না, কেউ হয়তো বাড়ি থেকে পড়াশোনা করবে, কেউবা সুযোগ পেলে চলে যাবে বিদেশে—এমনটাই বলছিলেন শাকিনা। মেয়েকে নিয়ে পরিবারে তিনিই সবচেয়ে ‘নার্ভাস’ বলে জানালেন। শাকিনা বললেন, ‘ও তো শুধু কাঁদে আর জিজ্ঞাসা করে, “মা, আমার কী হবে?” উত্তরটা তো দিতে হবে আমাকেই।’

শাকিনা আদিল

শাকিনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল গত অক্টোবরে রাজধানী কাবুলে হাসমত স্তানিকজাইয়ের বাড়িতে। হাসমত আমার দোভাষী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাঁরও একই সমস্যা। হাসমতের মেয়েও পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তার নামও আয়েশা। হাসমত জানে না বছর শেষ হলে মেয়ের পড়াশোনার কী হবে।

১৮৯২ সালে আফগানিস্তান নিয়ে ব্রিটিশ ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। সে সময় ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে রহমত নামের এক আফগান ফল বিক্রেতার কথা লিখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গল্পের এই রহমত কলকাতায় ফল বিক্রি করতেন। তিনি দীর্ঘদিন দেশে ফেরেননি, মেয়েকেও দেখেননি। সে কী করে, কত বড় হয়েছে—কিছুই জানতেন না। এ নিয়ে তাঁর দুঃখের শেষ ছিল না। ১৩৩ বছর পর আফগানিস্তানে বাস করা হাসমত যেন সেই ‘কাবুলিওয়ালা’। হাসমতের দুঃখেরও শেষ নেই। তাঁর মেয়ে কাছে থাকলেও যাবে না স্কুলে। গল্পের রহমতের মতোই মেয়ের ভবিষ্যতের উত্তর নেই হাসমতের কাছেও।

উদ্বেগ তালেবানের ভেতরেও

মেয়েসন্তানের পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তা শুধু শাকিনা বা হাসমতের মতো লাখ লাখ মা-বাবার, এমন নয়। তালেবানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মানুষও বললেন, মেয়েদের স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত তাঁরা সমর্থন করেন না। তবে সরাসরি নেতৃত্বের বিরোধিতা করতেও নারাজ তাঁরা।

পশ্চিম আফগানিস্তানের ফারাহ প্রদেশের মাওলানা আখতার জানের কথা বলেছিলাম আগের এক পর্বে। (কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২০ বছরের যুদ্ধ জিতল তালেবান) তিনি আফগানিস্তান ইসলামি আমিরাতের এক নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ নেতা মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার ইচ্ছাই তাঁর কাছে শেষ কথা।

কথার ফাঁকে একটু সংকোচ নিয়েই আখতার জানের কাছে জানতে চাইলাম, মেয়েদের স্কুলে না যেতে দেওয়ার বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা কী? তিনি বললেন, ‘এটি এমন একটি সমস্যা, যা নেতৃত্বকে ভাবাচ্ছে। মেয়েদের জন্য স্কুলের দরজা খুললে মন্দ হয় না। তবে নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’

আখতার জানের সঙ্গে আলাপের সময়ও আমার দোভাষী ছিলেন আয়েশার বাবা হাসমত। ভাষান্তর করে তিনি জানালেন, মেয়েদের স্কুল যেতে না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আখতার জান কয়েকজন তালেবান নেতার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ২০২১ সালের আগে আফগানিস্তান ত্যাগ নিয়ে মার্কিনরা যখন তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছিল, তখন এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ করলে তালেবানও আফগান মেয়েদের স্কুলে যেতে দেবে, এমনটাই কথা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি, তাই তালেবানও মেয়েদের স্কুলে যেতে দেয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র-তালেবানের সম্পর্কে নারী প্রসঙ্গ

কাবুলে ফিরে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে, আর ইন্টারনেট ঘেঁটে বুঝলাম, আখতার জানের বক্তব্য আংশিক সত্য। ২০২০ সালে দোহা চুক্তির সময় মেয়েদের নিয়ে তালেবানের সঙ্গে বিশেষ আলাপ-আলোচনায় যায়নি যুক্তরাষ্ট্র। চার পাতার চুক্তিতে কোথাও বলা হয়নি যে মেয়েদের স্কুলে ফেরত পাঠাতে হবে, তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিটি হয়েছিল নিরাপত্তার প্রশ্নে, তালেবান সংঘাত থেকে থেকে সরে আসবে এবং মার্কিন বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক পেশাদারেরা দেশে ফিরে যাবেন, এই ছিল মূল বক্তব্য।

তবে আখতার জানের কথা পুরোপুরি ভিত্তিহীনও নয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করেছিল, তখন তাদের অন্যতম দাবি ছিল দেশটিতে নারীদের স্বাধীনতা। অর্থাৎ আফগানিস্তান আক্রমণের সময় মার্কিনরা যে বিষয়টির ওপরে জোর দিয়েছিল, ২০ বছর পর দোহায় সে বিষয়ে জোর দেয়নি।

যদিও গত কয়েক বছরে আফগানিস্তানের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি ঘুরেফিরে এসেছে। যেমন ২০২২ সালের মার্চে কাতারে তালেবানের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, প্রাথমিকের পর নারীদের পড়াশোনা করতে না দেওয়ার কারণেই বৈঠক বাতিল করা হলো। দুই বছর পর ২০২৪ সালের জুন মাসে তালেবানের ভাষ্য ছিল, নারী স্বাধীনতা ‘আফগানিস্তানের বিষয়’। অর্থাৎ এ বিষয়ে অন্য দেশের পরামর্শ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

একটি বেসরকারি স্কুলে শিশুদের ছবি। এদের মধ্যে মেয়েরা আর কিছুদিন পরেই যেতে পারবে না স্কুলে

আফগানিস্তানে নারী স্বাধীনতা এবং মেয়েদের শিক্ষার প্রসঙ্গে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বললেন, ‘আসলে ইউরোপ-আমেরিকার আগ্রহটা অন্য জায়গায়। তারা চায়, আমরা তাদের কিছু দাবিদাওয়া মেনে কাজ করি। আমরা যদি তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু দাবিদাওয়া মেনে নিই, তবে তারাও নারী স্বাধীনতা, স্কুলশিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করবে না। এটা সমঝোতার একটা কৌশল।’

এই দাবিদাওয়ার অন্যতম হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বকে আবার আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করতে দেওয়া। আর অবশ্যই চীনকে খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়া। এ ধরনের দাবি মেনে নিলে নারী প্রসঙ্গ আর ইস্যু হবে না বলেই আফগান নেতৃত্বের বিশ্বাস। ফলে আখতার জান যে খুব ভুল বলেছেন, তা বোধ হয় ঠিক নয়।

দীর্ঘদিনের রক্ষণশীল সমাজ

তবে শুধু কূটনৈতিক কারণেই যে আফগানিস্তানে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, তা হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। আফগান সমাজ বরাবরই রক্ষণশীল। অন্তত বিগত ১০০ বছরে যখনই রাজনৈতিকভাবে আফগানিস্তান উত্তাল হয়ে উঠেছে, তখনই প্রথমে বিপদে পড়েছে নারীরা। এ কথা নিজের ‘দেশে বিদেশে’ বইয়ে লিখেছেন সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। প্রায় ১০০ বছর আগে আফগানিস্তানে পড়াতে গিয়েছিলেন মুজতবা আলী।

মুজতবা আলী আফগানিস্তানে পৌঁছানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাজা আমানুল্লাহ খানের সঙ্গে সে সময়ের বিখ্যাত ‘ওয়ার লর্ড’ বা যুদ্ধবাজ হাবিবুল্লাহ কালাকানির যুদ্ধ শুরু হয়। আজকের ‘সিভিল ওয়ার’ বা গৃহযুদ্ধের সঙ্গে সেই যুদ্ধের মিল বিস্তর। সে সময়ও প্রথমে বিপদে পড়েছিল নারীরা। হাবিবুল্লাহ কালাকানিকে রাজা আমানুল্লাহ প্রাথমিকভাবে পরাজিত করার পর দেখা গেল, আফগানিস্তানে নতুন নিয়মকানুন চালু হয়েছে। মুজতবা আলী লিখছেন, ‘মেয়ে ইস্কুল বন্ধ করা হয়েছে, রাস্তাঘাট থেকে ফ্রক-ব্লাউজ সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। যে মেয়েরা এখন রাস্তায় বেরোন, তাঁরা পরেন সেই তাম্বু ধরনের বোরকা।’

লন্ডনের ‘ওবি’ আর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মেয়েরা

আখতার জানের কথামতো মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধের পেছনে কূটনীতির বিষয়টিকে যদি একটা যুক্তি বলে ধরেও নেওয়া হয়, তাহলেও একটা প্রশ্ন ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি পালন করেনি বলে নিজের মেয়েদের শাস্তি দেওয়া কি উচিত? উত্তরটা দিলেন ‘ওবি’।

ওবির বড়সড় নাম আছে। কিন্তু সেই নাম ব্যবহার করতে তিনি এতবার নিষেধ করেছেন, আর এতবার নিজেকে ওবি বলে পরিচয় দিয়েছেন যে শেষ পর্যন্ত তাঁর পুরো নামই ভুলে গিয়েছি। আফগান পাঠানদের মধ্যে ওবি ব্যতিক্রম। তাঁর উচ্চতা পাঁচ ফুটের নিচে। ট্রাকচালক হিসেবে কাজ করেন লন্ডনে। ইংরেজি ভালোই বলেন, কিন্তু লন্ডন ছাড়তে চান। কারণ, ‘সেখানে অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে’। উপমহাদেশেই নাকি এখন সুখ, এমনটাই বললেন ওবি।

ওবির সঙ্গে আমার আলাপ হোটেলেই। প্রায় প্রতিরাতেই তিনি আমাকে নিয়ে খেতে বের হতেন। এক রাতে নিয়ে গেলেন চমৎকার এক চীনা খাবারের দোকানে—‘ল্যানজাও বিফ নুডল’। খেতে খেতে এক নারীকে দেখালেন—দোকানের চীনা রাঁধুনি। ওবিকে দেখে ক্ষুব্ধ মনে হলো। বললেন, ‘দেখুন মজাটা। মাথা সামান্যই ঢেকেছে। মুখ তো ঢাকেইনি। হেসে হেসে কথা বলছে ছেলেদের সঙ্গে। কোনো আফগান মেয়ে এ কাজ করলে তাকে জেলে পুরবে। যত অপরাধ যেন আফগানদের, আরও বেশি অপরাধ পাঠান মেয়েদের।’

আরিয়ান নাসিমিয়ার। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন তিনি

আফগানিস্তানে ঘুরলে দেখা যায় পাঠান নারীদের অধিকাংশেরই মাথা ও মুখ ঢাকা। তাজিক সম্প্রদায়ের মেয়েদের ক্ষেত্রে আইনের এত কড়াকড়ি নেই। অনুবাদক হাসমতের বাসায় তাঁর পরিচিত আরেক তরুণীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, ২০ বছরের আরিয়ান নাসিমিয়ার। দ্বাদশ শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার পর কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন। কিন্তু তারপরেই তালেবান ক্ষমতায় আসে। মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। এখন তিনি কী করেন—জিজ্ঞাসা করায় প্রায় কেঁদেই ফেললেন আরিয়ান।

ওবির কথা শুনে আরিয়ানের একটা পর্যবেক্ষণ মনে পড়ল। এই তরুণী বলছিলেন, ‘তালেবানের যত কড়াকড়ি পাঠান মেয়েদের জন্য। তাজিকদের তারা ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে। হাজারা সম্প্রদায়ের মেয়েরা তো মুখই ঢাকে না। উজবেকদের জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’

আরিয়ানের কথা যেমন সত্য, তেমন এটাও ঠিক যে হাজারা বা তাজিক নারীরা খুব ভালো আছেন, এমনটা নয়। অন্য সম্প্রদায়ের সামাজিক জগতে পাঠানরা অপেক্ষাকৃতভাবে কম নাক গলালেও একেবারে যে গলায় না, তা-ও নয়। এটা বোঝা গেল হাজারা–অধ্যুষিত বামিয়ান শহরে গিয়ে। তবে সংখ্যালঘু নারীদের কথা বলা যাবে অন্য পর্বে, আপাতত ফেরা যাক আখতার জানের প্রসঙ্গে।

‘অবশ্যই সে স্কুলে যাবে’

আখতার জানকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রতিশ্রুতি পালন না-ও করে, তারপরও কি নিজের দেশের মেয়েদের এভাবে শাস্তি দেওয়া উচিত? প্রশ্ন শুনে আখতার জান চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সূর্য তখন নেমে আসছে। বাইরের দৃশ্য মনোরম, দেখা যাচ্ছে রেললাইন, ট্রেন। এই ট্রেন ইরান থেকে মালপত্র হেরাতে নিয়ে আসে। বছর বিশেক আগে ইরানে দেখেছিলাম নারীদের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা। তবে তাঁদের পড়াশোনা বা অন্যান্য কাজকর্মে বাধা দেয়নি ইরান, যেমনটা দিচ্ছে আফগানিস্তান।

মাওলানা আখতার জান

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার একটু বিরক্ত করলাম আখতার জানকে। জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর মেয়ে কয়টি। বললেন, দুটি। জানতে চাইলাম, ২০২১ সালের আগে তারা সাধারণ স্কুলে যেত কি না। আখতার জান বললেন, অবশ্যই যেত। এরপর আমার স্বাভাবিক প্রশ্ন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে তারা কি আবার স্কুলে যাবে? তালেবান সেনার ততক্ষণাৎ জবাব, ‘অবশ্যই যাবে। পড়াশোনার প্রয়োজন আছে।’

শাকিনা-হাসমতের সমস্যা মিটল না

ভবিষ্যতের কথা পরে, আপাতত সমস্যা মিটছে না শাকিনা ও হাসমতের। ডিসেম্বর তো প্রায় শেষ হয়ে এল। মেয়েকে কী বোঝাচ্ছেন শাকিনা? ভাবলাম ফোন করি। কিন্তু তিনি তো ফারসি বা পশতু ভাষায় কথা বলবেন। কিছুক্ষণ ভেবে বার্তা পাঠালাম হাসমতকে। তাঁর মেয়েও স্কুলে যাবে না মাস ফুরোলে, সেও নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন। রাত পোহালে এসে পৌঁছাল কণ্ঠবার্তা—‘তালেবান নিষেধাজ্ঞা তোলেনি। আয়েশা বসতে পারবে না সপ্তম শ্রেণিতে। এখন কয়েক মাস ভাবব কী করা যায়। তারপর হয়তো তাকে দারুল উলুমের কোনো মাদ্রাসায় পাঠাবো বা এমন কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠাব, যেখানে ধর্মের পাশাপাশি কিছুটা অন্যান্য শিক্ষার ব্যবস্থাও আছে। তবে এখন আমরা পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি।’

লাখ লাখ মা-বাবার এই অনিশ্চয়তা কীভাবে কাটবে? আফগানিস্তানে এই ধরনের নীতিভিত্তিক প্রশ্নের জবাব খোঁজার দায়িত্ব ‘আমর বিল মা’আরুফ, ওয়াননাহয়ি আনিল মুনকার’-এর, যা হলো ‘সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজের নিষেধ’–বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

পররাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেয়ে এই মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা ও প্রভাব কম নয়, হয়তোবা বেশিই। শাকিনা-হাসমতদের সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলাম ‘আমর বিল মা’আরুফ, ওয়াননাহয়ি আনিল মুনকার’-এর মুখপাত্র সইফুল ইসলাম খাইবারের কাছে। বাকি কথা পরের পর্বে।