ইউরোপমুখী লাখো শরণার্থীর আশ্রয়ের জন্য যে দেশটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল প্রথম, সেই জার্মানিই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। দেখাদেখি অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়াসহ কয়েকটি দেশ ঘোষণা দিয়েছে, সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে তারাও।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার জরুরি বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা। খবর এএফপি ও বিবিসির।
জার্মানিতে আসা শরণার্থীদের বেশির ভাগেরই আশ্রয় হয়েছে মিউনিখ শহরে। গত রোববার মিউনিখ শহর কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়, তারা ধারণক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। এরপর জার্মানি অস্ট্রিয়া-সংলগ্ন সীমান্তে নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেয়। এই নিয়ন্ত্রণের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে রোববার জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টমাস দ্য মেজিয়র বলেন, ‘শরণার্থীদের বাড়তে থাকা স্রোত সামলানোই এর প্রধান উদ্দেশ্য।’
জার্মানি তাদের দেশের সঙ্গে অস্টি৶য়ার সীমান্তে প্রথমে কড়াকড়ি আরোপের ঘোষণা দেয়। এ পথেই বেশির ভাগ শরণার্থী ঢুকেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শরণার্থীদের নিয়ে এত বড় সংকটে পড়েনি ইউরোপ—এ কথা স্বীকার করেছে জার্মানি। এ বছর তাই দেশটি আট লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর সিগমার গ্যাব্রিয়েল বলেছেন, ‘আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমান, এই সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে দেবে।’
এ বছরের শুরু থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত জার্মানিতে ঢুকেছে সাড়ে চার লাখ শরণার্থী।
জার্মানি সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্তের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ গতকাল সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা তিনজন যুবককে আটকে দেয়। তাঁদের কাছে পাসপোর্ট দেখতে চায়। এঁদের একজন ২৭ বছর বয়সী হাতেম আলী আহাজ বলছিলেন, ‘২২ দিন ধরে হেঁটে এখানে এসেছি। আমরা ভেবেছিলাম জার্মানিই এখন একমাত্র দেশ, যারা আমাদের মতো মানুষদের মানুষ বলে মনে করে।’ অ্যাজমার রোগী আহাজ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন আর বলছিলেন কথাগুলো।
যে সীমান্ত চৌকিতে তিন যুবককে ঠেকিয়ে দেয় পুলিশ, সেখানেই কিছুক্ষণ পর আটক করা হয় এক মানব পাচারকারীকে। তবে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের ঘোষণার পর জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের মুখপাত্র স্তেফেন সিবার্ট বলেন, ‘জার্মানির দ্বার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না। শরণার্থীরা জার্মানিতে আসবে। আমরা চাই এটা আরও সুচারুভাবে হোক।’
অস্ট্রিয়া ও স্লোভাকিয়ার কড়াকড়ি: জার্মানির সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের ঘোষণার পর অস্ট্রিয়া শরণার্থীদের স্রোত সামলাতে সীমান্তে সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। অস্ট্রিয়ার ভাইস চ্যান্সেলর রেনহোল্ড মিটারলেনার বলেছেন, জার্মানি সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করলে অস্ট্রিয়াও ওই সব এলাকায় কড়াকড়ি করবে।’
হাঙ্গেরির সঙ্গে তাদের সীমান্তে শক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণাও দিয়েছে অস্ট্রিয়া। দেশটির সীমান্ত শহর নিকেলসডরফ দিয়ে গত রোববারই ১৪ হাজার শরণার্থী ঢুকে পড়ে। গতকাল সকালে আসে আড়াই হাজার। অস্ট্রিয়া থেকে জার্মানিতে চলাচলকারী ট্রেন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পর গত রোববার সারা রাত এক হাজারের বেশি শরণার্থীকে স্যালজবার্গ স্টেশনে রাত কাটাতে হয়।
এদিকে স্লোভাকিয়াও গতকাল ঘোষণা দিয়েছে, তারা হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়া সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে।
থামছে না মানবস্রোত: এত সব নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও ইউরোপমুখী মানুষের স্রোত কিন্তু থামছে না। গত রোববার হাঙ্গেরিতে ঢুকে পড়ে ৫ হাজার ৮০৯ জন শরণার্থী। এর আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৩৩০ জন। শরণার্থী প্রশ্নে কঠোর হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবানের আগে দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী, আজ মঙ্গলবারের মধ্যে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া শেষ করবে দেশটি। তারপর থেকে দেশে অবৈধ শরণার্থীদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছে হাঙ্গেরি।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সীমান্তে এই নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
এর আগে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রস্তাব পাস করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। তবে সেই আহ্বানে এখনো সম্মত হয়নি বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ। তবে মানবিক এই বিপর্যয়ে ইউরোপজুড়ে এসব মানুষকে আশ্রয় দিতে গত রোববার সমাবেশ হয়। আশ্রয়দানের বিরুদ্ধেও পাল্টা বিক্ষোভ হয়। তবে শরণার্থীদের সমর্থনে আয়োজিত সমাবেশে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি।