বিবিসির কার্যালয়
বিবিসির কার্যালয়

বিবিসির এক্সপ্লেইনার

বিবিসির মহাপরিচালক ও বার্তাপ্রধান কেন পদত্যাগ করলেন, ট্রাম্পের তথ্যচিত্রে সমস্যাটা কোথায়

বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি এবং সংবাদ বিভাগের প্রধান ডেবোরাহ টারনেস গতকাল রোববার পদত্যাগ করেছেন। প্যানোরমা অনুষ্ঠানে প্রচারিত এক তথ্যচিত্রকে কেন্দ্র করে বিবিসি ব্যাপক বিতর্কের মধ্যে আছে। আর এর মধ্যেই তাঁরা দুজন পদত্যাগ করেছেন।

বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানে প্রচারিত তথ্যচিত্রে ট্রাম্পের একটি ভাষণ ভুলভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ট্রাম্পের ভাষণের আলাদা আলাদা অংশ সেখানে জোড়া দেওয়া হয়েছে এবং সেটি শুনে মনে হচ্ছে ট্রাম্প মানুষকে ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করছেন।

কর্মীদের কাছে পাঠানো ই–মেইলে ডেভি ও টারনেস দুজনই ভুলভ্রান্তি হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

গত সপ্তাহে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, বিবিসির অভ্যন্তরীণ একটি চিঠি ফাঁস হয়েছে। বিবিসির সম্পাদকীয় মান পর্যালোচনাবিষয়ক কমিটির সাবেক স্বাধীন উপদেষ্টা মাইকেল প্রেসকট চিঠিটি দিয়েছিলেন।

টিম ডেভি ও ডেবোরাহ টারনেস কে

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিসির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান টিম ডেভি। তিনি বিবিসির বিভিন্ন বিভাগ ও শাখার কার্যক্রম তদারক করতেন এবং এর সম্পাদকীয়, কার্যক্রম পরিচালনা ও অন্য সৃজনশীল কাজগুলোতে নেতৃত্ব দিতেন।

ডেভি যে বিবিসিতে নতুন মুখ ছিলেন, তা নয়। মহাপরিচালক হওয়ার আগে তিনি সাত বছর ধরে বিবিসি স্টুডিওসের প্রধান নির্বাহী পদে ছিলেন।

বিবিসিতে যোগদানের আগে প্রোক্টার অ্যান্ড গ্যাম্বল এবং পেপসিকোর মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন ডেভি।

আর ডেবোরাহ টারনেস ২০২২ সাল থেকে বিবিসি নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। যেখানে তিনি বিবিসি নিউজ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স প্রোগ্রামের তদারক করেন।

টিম ডেভি

টারনেস প্রায় ছয় হাজার কর্মীকে নেতৃত্ব দিতেন। এসব কর্মী বিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি মানুষের কাছে ৪০টির বেশি ভাষায় সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন।

বিবিসিতে যোগ দেওয়ার আগে টারনেস আইটিএনর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১৩ সাল থেকে এনবিসি নিউজের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

কেন তাঁরা পদত্যাগ করলেন

বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানে ‘ট্রাম্প আ সেকেন্ড চান্স’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্রকে কেন্দ্র করে বিতর্কের পর ডেভি ও টারনেস পদত্যাগ করেছেন। এই তথ্যচিত্র গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে সম্প্রচার করা হয়েছিল।

পদত্যাগের বিষয়ে দেওয়া বিবৃতিতে ডেবোরাহ টারনেস বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প–সম্পর্কিত প্যানোরমা নিয়ে চলমান বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বিবিসিকে ক্ষতির মুখে ফেলছে। এটি আমার ভালোবাসার একটি প্রতিষ্ঠান। বিবিসি নিউজ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে চূড়ান্ত দায় আমার। গত রাতে আমি মহাপরিচালকের কাছে পদত্যাগের প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

বিবিসির মহাপরিচালক হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের সময় টিম ডেভি অনেক বিতর্ক ও সংকট সামলেছেন। এর মধ্যে ছিল গ্যারি লিনেকার বিতর্ক, গ্লাস্টনবারিতে বব ভিলেনর ঘটনা, গাজাসংক্রান্ত তথ্যচিত্র নিয়ে বিতর্ক এবং একাধিক জনপ্রিয় উপস্থাপকের অনৈতিক আচরণসংক্রান্ত বিতর্ক। তবে এগুলোর কোনোটিই তাঁর ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি।

টারনেস আরও বলেন, ‘ভুলভ্রান্তি হয়েছে ঠিকই, তবে আমি এটা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, বিবিসি নিউজের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতের অভিযোগটি ঠিক নয়।’

ডেভি তাঁর বিবৃতিতে প্যানোরমায় প্রচারিত তথ্যচিত্রের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি। তবে তিনি বলেন, ‘একমাত্র কারণ না হলেও, বিবিসি নিউজকে কেন্দ্র করে চলমান বিতর্ক স্বাভাবিকভাবেই আমার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে। মোটের ওপর বিবিসি ভালোভাবে কাজ করছে। তবে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছে এবং মহাপরিচালক হিসেবে আমাকে চূড়ান্ত দায়ভারটা নিতে হবে।’

ট্রাম্পের তথ্যচিত্র নিয়ে অভিযোগ কী

গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, বিবিসির অভ্যন্তরীণ একটি চিঠি ফাঁস হয়েছে। বিবিসির সম্পাদকীয় মান পর্যালোচনাবিষয়ক কমিটির সাবেক স্বাধীন উপদেষ্টা মাইকেল প্রেসকট চিঠিটি দিয়েছিলেন।

প্রেসকট ওই চিঠিতে বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানে গত বছর প্রচারিত একটি তথ্যচিত্রের বিষয়ে অভিযোগ করেন। বলেন, এক ঘণ্টার তথ্যচিত্রটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণ ভুলভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার ঘটনায় ট্রাম্পের দেওয়া ভাষণের বিভিন্ন অংশ কেটে একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভাষণটি শুনতে জোড়া দেওয়া ভাষণের মতো মনে হয়নি। শুনতে মনে হচ্ছিল, ট্রাম্প ওই দাঙ্গার ঘটনায় উসকানি দিচ্ছেন।

ওয়াশিংটন ডিসিতে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প আসলে বলেছিলেন, ‘আমরা ক্যাপিটলের দিকে হেঁটে যাব এবং আমাদের সাহসী সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের জন্য উল্লাস করব।’

অথচ প্যানোরামা তথ্যচিত্রে সম্পাদিত ভাষণে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা ক্যাপিটলের দিকে হেঁটে যাব। আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব ও লড়ব। আমরা প্রাণপণ লড়াই করব।’

ট্রাম্পের ভাষণের যে আলাদা দুটি অংশ জোড়া দেওয়া হয়েছে, তার একটির সঙ্গে আরেকটির সময়ের ব্যবধান ছিল ৫০ মিনিটের বেশি।

ডেবোরাহ টারনেস

‘প্রাণপণ লড়াই’ করার কথাটি ট্রাম্প আসলে এমন একটি অংশে বলেছেন, যেখানে তিনি মার্কিন নির্বাচনে ‘দুর্নীতি’ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। মোট কথা, তিনি ভাষণে ২০ বার লড়াই করার কথা উল্লেখ করেছেন।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিবিসি আরও নানা বিষয় নিয়ে সমালোচনার মধ্যে পড়েছে।

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রেসকট তাঁর চিঠিতে এটাও অভিযোগ করেছিলেন, বিবিসি অ্যারাবিকে গাজা যুদ্ধের খবর প্রচারের ক্ষেত্রে ‘ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাত’ এবং ‘পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো’ মোকাবিলায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

কেন টিম ডেভি এখন পদত্যাগ করলেন

বিবিসির মহাপরিচালক হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের সময় টিম ডেভি অনেক বিতর্ক ও সংকট সামলেছেন। এর মধ্যে ছিল গ্যারি লিনেকার বিতর্ক, গ্লাস্টনবারিতে বব ভিলেনর ঘটনা, গাজাসংক্রান্ত তথ্যচিত্র নিয়ে বিতর্ক এবং একাধিক জনপ্রিয় উপস্থাপকের অনৈতিক আচরণসংক্রান্ত বিতর্ক।

তবে এগুলোর কোনোটিই তাঁর ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর জন্য গণমাধ্যম জগতের কেউ কেউ তাঁকে ‘টেফলন টিম’ নামে ডাকতে শুরু করেছিলেন। কারণ, টেফলন নামের নন–স্টিক পাত্রে যেমন কোনো কিছু আটকে থাকে না, তেমনি তাঁর ওপরও কোনো বিতর্কের ছাপ লেগে থাকত না।

সর্বশেষ ট্রাম্প-প্যানোরামা বিতর্কের শুরুতেও তিনি স্থির থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আশা করা হচ্ছিল, বিবিসি কর্তৃপক্ষ এই তথ্যচিত্র নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইবে।

এই ঘটনা এমন এক স্পর্শকাতর সময়ে ঘটেছে, যখন ব্রিটিশ সরকার বিবিসির রয়্যাল চার্টার (প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বের আইনগত ভিত্তি) পুনর্মূল্যায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর বর্তমান মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে।

পদত্যাগের বিষয়ে দেওয়া বিবৃতিতে ডেভি বলেন, ‘আপনারা হয়তো জানতে চাইবেন—কেন এখন, কেন এই মুহূর্তে?’

ডেভির দাবি, তিনি পুরোপুরি বিবিসির প্রতি নিবেদিত মানুষ। তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে গভীরভাবে ভালোবাসেন এবং এর সফলতা দেখতে চান। এ কারণেই তিনি এমন পরিবেশ তৈরি করে দিতে চেয়েছেন, যেখানে একজন নতুন মহাপরিচালক এসে পরবর্তী রয়্যাল চার্টারকে ইতিবাচক রূপ দিতে পারবেন।

কীভাবে টিম ডেভির উত্তরসূরি বাছাই করবে বিবিসি

বিবিসিতে মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়ার কাজটি করে বিবিসি বোর্ড। এ বোর্ডের দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ও জনসেবা কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা।

বিবিসি বোর্ডের নেতৃত্ব দেন চেয়ারম্যান সমির শাহ। বোর্ডে ১০ জন নন-এক্সিকিউটিভ সদস্য ও ৪ জন এক্সিকিউটিভ সদস্য (যার মধ্যে মহাপরিচালকও রয়েছেন) আছেন।

২০২০ সালে ডেভি যখন মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান, তখন এই পদে কে বসবে, তা নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেছিল বিবিসি বোর্ডের মনোনয়ন কমিটি।

মহাপরিচালকের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বিবিসির চার্টার অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। ডেভির উত্তরসূরি ব্যক্তি হবেন বিবিসির ১০৩ বছরের ইতিহাসে ১৮তম মহাপরিচালক।

এই পদে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁর মধ্যে আছেন শার্লট মুর। তিনি সম্প্রতি বিবিসির চিফ কনটেন্ট অফিসার হিসেবে পদত্যাগ করেছেন। শার্লট মুর সংবাদ ছাড়া অন্য সব অনুষ্ঠানের তদারক করতেন। সম্ভাব্য ব্যক্তিদের তালিকায় ব্রিটিশ টেলিভিশনের অন্যতম অভিজ্ঞ নির্বাহী জে হান্ট এবং বিবিসির সাবেক বার্তাপ্রধান (২০১৩-১৮) জেমস হার্ডিংয়ের নামও শোনা যাচ্ছে।