নৌ শক্তিতে সেরা ১০ দেশ

সমুদ্রসীমা সুরক্ষা, বৈশ্বিক কূটনীতিতে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই—এ তিনটি অদৃশ্য বিষয় আধুনিক যুদ্ধজাহাজভিত্তিক নৌ শক্তির অন্তর্নিহিত চালিকা শক্তি। আধুনিক বিশ্বে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব শুধু আকাশ বা স্থলেই নয়, বরং সমুদ্রেও নির্ধারিত হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ডিরেকটরি অব মডার্ন মিলিটারি ওয়ারশিপ ২০২৫-এর সর্বশেষ তালিকায় উঠে এসেছে বিশ্বের ১০টি প্রধান নৌ শক্তিধর দেশের সক্রিয় যুদ্ধজাহাজ বহরের তথ্য, যা শুধু তাদের প্রতিরক্ষা কৌশল নয়, বরং বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যও নির্দেশ করে। এ তালিকায় সংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে চীন, তবে আধুনিক প্রযুক্তি, পারমাণবিক সক্ষমতা ও বহরের গুণমানে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরল্ড আর. ফোর্ড বিশ্বের সর্ববৃহৎ রণতরি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী (ইউএসএন)। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর শক্তির মূলে রয়েছে তাদের হাতে থাকা পারমাণবিক শক্তিচালিত অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণতরি। রণতরিগুলো নিমিটজ শ্রেণির। এ শ্রেণির রণতরি পারমাণবিক শক্তিচালিত, বিশালাকৃতির ও বহু যুদ্ধবিমান বহনে সক্ষম, যা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

তবে এসব রণতরি পুরোনো হতে শুরু করেছে এবং সেগুলো ধীরে ধীরে অবসরে পাঠানো হবে। প্রতিটি নিমিটজ শ্রেণির রণতরির জায়গায় যুক্ত হবে অত্যাধুনিক ফোর্ড শ্রেণির সুপারক্যারিয়ার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর তৈরি অত্যাধুনিক, পারমাণবিক শক্তিচালিত একটি নতুন প্রজন্মের বিমানবাহী রণতরি শ্রেণি। নিমিটজ শ্রেণির উত্তরসূরি এ রণতরি উন্নত প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ও কার্যক্ষমতায় অনেক এগিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বর্তমান সক্রিয় নৌবহরে ২৩২টি নৌযান রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি বিমানবাহী রণতরি (১০টি নিমিটজ শ্রেণি ও একটি ফোর্ড শ্রেণির)।

আরও রয়েছে ৬৮টি সাবমেরিন ও ৯টি যুদ্ধজাহাজ। যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনও আছে, যেগুলোতে মোতায়েন করা আছে আন্তমহাদেশীয় পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকা অন্যান্য যুদ্ধজাহাজের মধ্যে রয়েছে ৭৬টি ডেস্ট্রয়ার। কম শব্দে চলতে পারা ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ডেস্ট্রয়ারগুলো মার্কিন নৌবহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিগেট নেই। কর্ভেট আছে ২৬টি ও উভচর যুদ্ধজাহাজ ৩৪টি এবং মাইন ওয়ারফেয়ার ৮টি।

সক্রিয় নৌবহরের এ তালিকায় মূলত সামনের সারির কমিশনপ্রাপ্ত সামরিক নৌযানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ছোট টহল জাহাজ, সহায়ক বা জরিপ জাহাজ, রসদ সরবরাহকারী জাহাজ ও ঐতিহাসিক বা আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত জাহাজগুলো তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

চীন

দক্ষিণ চীন সাগরে একটি সামরিক মহড়ায় চীনের পারমাণবিক শক্তিচালিত ০৯৪এ জিন-ক্লাস ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিন

গত কয়েক দশকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি নৌবাহিনীর (পিএলএএন) শক্তি দ্রুত বেড়েছে। এ সময়ে পিএলএএনের বহরে পানির ওপরে ও নিচে চলাচলে সক্ষম আধুনিক নৌযানের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক জাহাজ। পিএলএএনের সাবমেরিন বহর অপেক্ষাকৃত নতুন।

তাদের রয়েছে ৭৩টি সাবমেরিন। সেগুলোর মধ্যে ১৮টি পারমাণবিক শক্তিচালিত। চীনের নৌবহরের মূলশক্তির অন্যতম তাদের তিনটি বিমানবাহী রণতরি। এ ছাড়া আছে ৪৭টি ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট ৪৯টি, কর্ভেট ৫০টি, মাইন ওয়ারফেয়ার ৪৩টি, উপকূলীয় টহল যুদ্ধজাহাজ ১২৭টি ও ১৩টি উভচর জাহাজ।

চীনের সক্রিয় নৌবহরে মোট ৪০৫টি নৌযান রয়েছে। এ তালিকায় মূলত সামনের সারির কমিশনপ্রাপ্ত সামরিক নৌযানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে তালিকা থেকে ছোট টহল জাহাজ, সহায়ক বা জরিপ জাহাজ, রসদ সরবরাহকারী জাহাজ ও ঐতিহাসিক বা আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত জাহাজগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। চীনের নৌবহরে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সংখ্যায় বেশি সামরিক নৌযান রয়েছে। তবে শক্তির বিচারে যুক্তরাষ্ট্র এখনো এগিয়ে।

রাশিয়া

কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার ক্রুজার মস্কভা

রাশিয়ার আধুনিক নৌবাহিনী এখনো নিজেদের উপকূলরেখা রক্ষা ও পানির নিচের কর্মকাণ্ডকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এখনো দেশটির নৌ শক্তির মূল উৎস তাদের আকারে ছোট কিন্তু দ্রুতগামী যুদ্ধজাহাজ কর্ভেট ও ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিন।

রাশিয়ার নৌবাহিনীর হাতে বিভিন্ন শ্রেণির ৮৩টি কর্ভেট ও ৫৮টি সাবমেরিন আছে। রয়েছে একটি বিমানবাহী রণতরি। এ ছাড়া রয়েছে ভারী সশস্ত্র যুদ্ধজাহাজ ৪টি, ডেস্ট্রয়ার ১০টি, ফ্রিগেট ১২টি, মাইন ওয়ারফেয়ার ৪৮টি, ওপিভি ৫০টি ও উভচর জাহাজ ১৭টি।

রাশিয়ার বর্তমান সক্রিয় নৌবহরে মোট ২৮৩টি নৌযান রয়েছে। এ তালিকায় মূলত সামনের সারির কমিশনপ্রাপ্ত সামরিক নৌযানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় ছোট টহল জাহাজ, সহায়ক বা জরিপ জাহাজ, রসদ সরবরাহকারী জাহাজ এবং ঐতিহাসিক বা আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত জাহাজগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি ও বোর্নিও দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত মাকাসার সাগরে নৌ মহড়ায় দেশটির নৌবাহিনী

ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর মোট ২৪৫টি সক্রিয় যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। দেশটিতে কোনো বিমানবাহী রণতরি নেই। তবে ৪টি সাবমেরিন, ৭টি ফ্রিগেট ও ২৫টি কর্ভেট আছে। ইন্দোনেশিয়া হলো বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জ।

ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে কয়েক হাজার দ্বীপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গঠিত। নিজেদের সমুদ্রসীমা সুরক্ষিত রাখতে ইন্দোনেশিয়ার ১৬৮টি উপকূলীয় টহল যুদ্ধজাহাজের (ওপিভি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া দেশটির ৩২টি উভচর এবং ৯টি মাইন ওয়ারফেয়ার আছে।

দক্ষিণ কোরিয়া

যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সামরিক নৌযানের সঙ্গে নৌ মহড়ায় অংশ নিয়েছে রিপাবলিক অব কোরিয়া নৌবাহিনীর একটি ডেস্ট্রয়ার

প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার তুলনায় সংখ্যা ও মানগত দিক দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনী ‘রিপাবলিক অব কোরিয়া নেভি (আরওসিএন)’ স্পষ্টভাবে এগিয়ে। আরওসিএনের বিভিন্ন শ্রেণির ২১টি সাবমেরিন, ১৩টি ডেস্ট্রয়ার ও ১৭টি ফ্রিগেট এবং ৬৯টি ওপিভি রয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার নৌ–সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ও এর শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরি বহরের ওপরও নির্ভরশীল। পাশাপাশি আঞ্চলিক কয়েকটি মিত্রদেশের সহায়তাও তারা পায়।

সব মিলিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সক্রিয় নৌবহরে ১৪৭টি সামরিক নৌযান রয়েছে। তবে এ তালিকায় ছোট টহল জাহাজ, সহায়ক বা জরিপ জাহাজ, রসদ সরবরাহকারী জাহাজ ও ঐতিহাসিক বা আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত জাহাজগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

জাপান

আকাশ থেকে তোলা ছবিতে জাপানের নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ইজুমো (ডিডিএইচ ১৮৩

জাপানের নৌবাহিনী ‘জাপান মেরিটাইম সেলফ-ডিফেনস ফোর্স’-এর সক্রিয় নৌবহরে মোট ১০৫টি সামরিক নৌযান রয়েছে। এর মধ্যে দুটি হেলিকপ্টারবাহী রণতরি, ২৪টি সাবমেরিন, ৪২টি ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট ৬টি, মাইন ওয়ারফেয়ার ২২টি, অফশোর পেট্রল ভেসেল (ওপিভি) ৬টি ও উভচর জাহাজ ৩টি। সব মিলিয়ে জাপানের সক্রিয় নৌবহরে ১০৫টি সামরিক নৌযান রয়েছে।

ভারত

ভারতে তৈরি প্রথম বিমানবাহী রণতরি আইএনএস বিক্রান্ত

দক্ষিণ এশিয়ায় যেসব দেশের শক্তিশালী নৌবাহিনী আছে, তাদের একটি ভারত। দেশটির দুটি বিমানবাহী রণতরি আছে। সেগুলোর একটি আইএনএস বিক্রমাদিত্য ও অন্যটি আইএনএস বিক্রান্ত।

আইএনএস বিক্রমাদিত্য ২০১৪ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়। এটি সাবেক সোভিয়েত আমলের রণতরি। চার বছর পর ২০১৮ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয় দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরি আইএনএস বিক্রান্ত।
এ ছাড়া ভারতের রয়েছে ১৩টি ডেস্ট্রয়ার, ১৪টি ফ্রিগেট, ১৮টি কর্ভেট, ওপিভি ২৯টি ও ৫টি উভচর জাহাজ। আরও আছে ১৯টি সাবমেরিন। দুটি সাবমেরিন পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন।

সব মিলিয়ে ভারতের সক্রিয় নৌবহরে মোট ১০০টি কমিশনপ্রাপ্ত নৌযান রয়েছে। ছোট টহল জাহাজ, সহায়ক বা জরিপ জাহাজ, রসদ সরবরাহকারী জাহাজ ও ঐতিহাসিক বা আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত জাহাজগুলো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ফ্রান্স

ভূমধ্যসাগরে ফ্রান্সের বিমানবাহী রণতরি শার্ল দ্য গল

ফরাসি নৌবাহিনী আধুনিক ও বহু কার্যক্ষম একটি বাহিনী। ফ্রান্সের নৌবাহিনীতে আকাশ, সমুদ্র ও সমুদ্রের নিচে যুদ্ধ করতে সক্ষম নৌযান রয়েছে। নৌবহরে বিমানবাহী রণতরি একটি (শার্ল দ্য গল)। পারমাণবিক শক্তিচালিত এ রণতরিতে রাফাল যুদ্ধবিমান পরিচালনার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা রয়েছে।

ফ্রান্সের নৌবাহিনীতে সাবমেরিন আছে আটটি। রয়েছে ডেস্ট্রয়ার ২১টি, মাইন ওয়ারফেয়ার ১৭টি, উভচর যুদ্ধজাহাজ ৩টি এবং ওপিভি ২০টি।

সব মিলিয়ে ফ্রান্সের সক্রিয় নৌবহরে মোট ৭০টি কমিশনপ্রাপ্ত নৌযান রয়েছে। ছোট টহল জাহাজ, সহায়ক বা জরিপ জাহাজ, রসদ সরবরাহকারী জাহাজ ও ঐতিহাসিক বা আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত জাহাজগুলো এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

যুক্তরাজ্য

পোর্টসমাউথে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভির বিমানবাহী রণতরি এইচএমএস কুইন এলিজাবেথ

বিশ্বের প্রাচীনতম নৌবাহিনীর একটি ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি। তাদের রয়েছে দুটি অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণতরি। নাম এইচএমএস কুইন এলিজাবেথ ও এইচএমএস প্রিন্স অব ওয়েলস। রণতরি দুটির মূল সক্ষমতা এটির ফিক্সড-উইং এফ-৩৫ যুদ্ধজাহাজ ওড়ার ব্যবস্থা। এ ছাড়া এগুলো অত্যাধুনিক সেন্সর, প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে সজ্জিত। ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই দুটি রণতরি।

এই নৌবাহিনীর আরও আছে ৯টি সাবমেরিন, ৬টি ডেস্ট্রয়ার, ৮টি ফ্রিগেট, ৭টি মাইন ওয়ারফেয়ার ও ১৮টি ওপিভি।

সব মিলিয়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে ৫০টি কমিশনপ্রাপ্ত নৌযান আছে। ছোট টহল জাহাজ, সহায়ক বা জরিপ জাহাজ, রসদ সরবরাহকারী জাহাজ ও ঐতিহাসিক বা আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত জাহাজগুলো এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তুরস্ক

হাইফা বন্দরে তুরস্কের একটি ফ্রিগেট

তুরস্কের নৌ শক্তির মূলে রয়েছে একটি হেলিকপ্টারবাহী রণতরি। ২০২৩ সালের এপ্রিলে এটি দেশটির নৌবহরে কমিশনপ্রাপ্ত হয়। তুরস্কের আরও আছে ১৩টি সাবমেরিন, ফ্রিগেট ১৭টি, কর্ভেট ৯টি, মাইন ওয়ারফেয়ার ১১টি, অফশোর পেট্রল ভেসেল (ওপিভি) ৩৪টি ও ৫টি উভচর জাহাজ।