হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ?

‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি আর থাকছে না। পাল্টে নতুন নাম ‘বাংলা’ হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বাংলা নামে সম্মতি দিয়েছে রাজ্যের সব রাজনৈতিক দল। সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব।

পশ্চিমবঙ্গ নাম বদলের দাবি অনেক দিনের, সেই বাম আমল থেকে। কিন্তু বিরোধী দলের চাপের মুখে সেই নাম বদলের প্রস্তাব আর জীবন পায়নি। ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নাম বদলের দাবি ওঠে মূলত ইংরেজিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল কথাটির কারণে। ইংরেজি অক্ষর ‘ডব্লিউ’ দিয়ে ওয়েস্ট শব্দটি শুরু। এতে সরকারি খাতায় ওয়েস্ট বেঙ্গল নামটি তালিকার শেষের দিকে থাকে।

কেন্দ্রীয় সরকার বা দিল্লির কোনো সরকারি বৈঠকে যখন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিরা যোগ দেন, তখন তাঁদের ডাক পড়ে একেবারে শেষের দিকে। এটাই মেনে নিতে পারেনি তৎকালীন বাম সরকার। ২০১১ সালের মে মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে নাম বদলের উদ্যোগ নেন। তিনি ওই বছরের আগস্ট মাসে এক সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। সেখান থেকে শুরু। নাম বদলের প্রস্তাব পাস হয় গতকাল বৃহস্পতিবার।

এখন কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাব মেনে নিলে কাগজে-কলমে মুছে যাবে ‘পশ্চিমবঙ্গের’ নাম। মুছে যাবে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নামটিও। ‘বাংলা’ নামটিই পরিচিত হয়ে উঠবে।

নাম বদলের প্রস্তাব প্রথম এসেছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় সেই ১৯৯৯ সালের ২০ জুলাই। এরপর অবশ্য কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে কিছু সংশোধনী আনা হয়। তারপর পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বাম সরকার আর নাম বদলের সেই ফসল ঘরে তুলে আনতে পারেনি। ১৭ বছর পর ২০১৬ সালে নাম বদলের প্রস্তাব সফল করার জন্য মাঠে নামেন মমতা।

২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট রাজ্য বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, বাংলায় নাম হবে ‘বাংলা’। ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’। আর হিন্দিতে ‘বাঙ্গাল’। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এক চিঠিতে জানায়, যে নামই হোক না কেন, তা একটিই হতে হবে। বিভিন্ন ভাষায় একই নাম রাখতে হবে। এতে রাজ্য সরকার তিন ভাষাতেই নাম ‘বাংলা’ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

২০১৬ সালের ২ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ অথবা ‘বঙ্গ’ রাখার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। ওই প্রস্তাব পাসের পর সেদিন রাজ্যজুড়ে বিতর্কও শুরু হয়েছিল। সেদিন কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনেরা এটি নিয়ে তাঁদের মিশ্র প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করেছিলেন। তবে অধিকাংশ ব্যক্তি মত দিয়েছিলেন বাংলার পক্ষে। কেউ অবশ্য ‘বঙ্গ’ নাম না রেখে ‘বঙ্গপ্রদেশ’ রাখার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কারও কারও মতে, ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ হবে কেন? রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ বা ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ এর পরিবর্তে ‘বাংলা’ রাখা হোক।

কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো কিছুর নাম পরিবর্তনের পক্ষপাতী আমি নই।’ কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘নাম বদল সমীচীন হয়েছে। বাংলা নামটাই ভালো হবে। ইংরেজিতে আলাদা নাম বেঙ্গল করার প্রয়োজন নেই।’ সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, ‘নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত সঠিক। আমি বাংলা নামটাই চাইছি।’ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার মত দিয়েছিলেন, ‘আমি চাইছি রাজ্যের নাম হোক বঙ্গ।’ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথা ছিল, ‘পূর্ববঙ্গ বলে যখন কিছু নেই, তখন পশ্চিমবঙ্গ থাকবে কেন? তবে বঙ্গভূমি হলে ভালো হয়।’ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বঙ্গভূমি হলে ভালো হয়।’

এখন অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ বা ইংরেজিতে ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম সরকারি তালিকার শেষের দিকে। নাম পরিবর্তন হলে সরকারি তালিকার চতুর্থ স্থানে চলে আসবে বাংলার নাম। অন্ধ্র প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, আসামের পরে বাংলা। এরপর আসবে বিহারের নাম। এর আগেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নাম পরিবর্তন হয়েছে। সংযুক্ত প্রদেশের নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছে উত্তর প্রদেশ, হায়দরাবাদের পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্য ভারতের নাম হয়েছে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাঞ্চলের পরিবর্তে হয়েছে উত্তরাখন্ড, উড়িষ্যার পরিবর্তে হয়েছে ওডিশা, ত্রিবাঙ্কুর-কোচিনের পরিবর্তে কেরালা, মাদ্রাজের পরিবর্তে তামিলনাড়ু এবং মহীশূরের পরিবর্তে হয়েছে কর্ণাটক রাজ্য।

বাংলা নামের প্রস্তাব পাস হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে মমতা বলেছেন, ‘আজ বাংলা ভাষা বিশ্বের পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। এটা আমাদের গর্ব। আর এই ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিতে হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলায় হবে বাংলা, ইংরেজিতে বেঙ্গল এবং হিন্দিতে বাঙ্গাল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে একটি নাম। তাই আমরা বাংলাই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হিন্দি ও ইংরেজিতেও লিখতে হবে বাংলা।’

‘বাংলা’ নাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল রাজনৈতিক মহলে। কেউ কেউ বলেছিলেন, রাজ্যের নাম বাংলা হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যা হতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের স্লোগান হলো ‘জয় বাংলা’। এ প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল ঠিকই আছে। পাশে বাংলাদেশ তো একটি আলাদা দেশ। রাজ্যের নাম বাংলা হলে অসুবিধে কোথায়? পাকিস্তানেও পাঞ্জাব আছে, আমাদের দেশেও পাঞ্জাব আছে।’