
দেশের বড় বড় সংবাদপত্রের পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন। কোনোটি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে, কোনোটি জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পর গত চার বছরে জম্মু-কাশ্মীর সব দিকে কী বিপুল ‘উন্নতি’ করেছে, ‘প্রগতি’ কতটা দুর্বার, ‘প্রশান্তি’ কী অপার, জনজীবন কতটা ‘স্বাভাবিক’, বিজ্ঞাপনজুড়ে চলেছে তারই প্রচার। অথচ গতকাল শুক্রবার রাত থেকে শুরু করে আজ শনিবার সারাটি দিন উপত্যকার সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা গৃহবন্দী!
জঙ্গিয়ানার রাশ টানার সরকারি দাবির মুখে শুক্রবার উপত্যকার কুলগাম জেলায় সেনা-জঙ্গির গুলির লড়াইয়ে তিন জওয়ান নিহত হন। সরকারের জোরালো দাবি, গত চার বছরে জঙ্গি উপদ্রব ৪৫ শতাংশ কমেছে। অথচ গত এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে জঙ্গি আক্রমণে ১৩ সেনাসদস্যের মৃত্যু হয়েছে।
জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সেই অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীয় সরকার খারিজ করে দেয়। সেই সঙ্গে রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। ওই সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর শুনানি দীর্ঘ চার বছর পর সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে শুরু হয়েছে। সেখানেও কেন্দ্রীয় সরকার গত চার বছরের বিপুল সাফল্যের দাবি জানিয়ে রেখেছে। শুধু তা–ই নয়, এ দিনটি উদ্যাপনের জন্য জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কয়েক দিন ধরে ব্যাপক প্রচারও চালিয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের করে রেখেছে গৃহবন্দী।
শনিবার সকালেই পিডিপি নেত্রী ও অধুনালুপ্ত এই রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি টুইট করে জানিয়ে দেন, আগের রাত থেকে তাঁকে ও তাঁর দলের সব শীর্ষ নেতাকে গৃহবন্দী রাখা হয়েছে। তিনি জানান, শুক্রবার রাত থেকেই ব্যাপক পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়। নেতা-কর্মীদের জবরদস্তি গৃহবন্দী করা রাখা হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ থাকার সরকারি দাবি কতটা ভ্রান্ত এটা তারই প্রমাণ। টুইটের সঙ্গে তিনি বাড়ির সদর দরজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ রাখার ছবিও জুড়ে দিয়েছেন।
অন্য একটি টুইটে মেহবুবা একটি ভিডিও ক্লিপিং জুড়ে দিয়েছেন, যাতে তাঁর দাবি, শুক্রবার মধ্যরাতে পুলিশ তাঁর দলের এক নেতাকে বাড়ি থেকে বের করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
উপত্যকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ৫ আগস্ট দিনটি ‘সংবিধান উল্লঙ্ঘন ও গণতন্ত্র হত্যাকারী কালা দিবস’। মেহবুবা মুফতি বলেন, এই দিনে তাঁরা একটি আলোচনা সভা করতে প্রশাসনের অনুমতি চেয়েছিলেন। দলের সদর দপ্তরের কাছে শের-ই-কাশ্মীর পার্কে সেই আলোচনা সভা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার অনুমতি না দেওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়।
পিডিপি নেত্রীর দাবি, ওই আলোচনা সভায় সমমনা সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অথচ শনিবার ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ উদ্যাপনে বিজেপিকে সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
মেহবুবা এই ‘দ্বিচারিতা’র উল্লেখ করে টুইটে বলেছেন, ‘স্বাভাবিকতার দাবি কতটা মেকি, সরকার ও প্রশাসনের এই মনোভাবই তার প্রমাণ। দেশের মানুষের চোখে ধুলা দিতে বিজেপি এই তামাশা চালিয়ে যাচ্ছে।’
জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ উদ্যাপনের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জনগণকে কীভাবে দমিয়ে রাখা হয়েছে—এসব তারই প্রমাণ। তাঁর আশা, শুনানি চলাকালীন সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেন।
বিরোধীদের অভিযোগ নিয়ে সরকার ও প্রশাসন অবশ্য নির্বাক। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে সরকারি প্রচারে বলা হচ্ছে, যত দিন ৩৭০ অনুচ্ছেদ বহাল ছিল, তত দিন জম্মু-কাশ্মীর ছিল সন্ত্রাসীদের নির্বিঘ্ন বিচরণভূমি। সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ইটপাটকেল ছোড়া, অনুপ্রবেশ, নির্বাচনের নামে প্রহসন, নৈরাজ্য ও ধর্মঘটে জেরবার হয়ে গিয়েছিল রাজ্যটা। চার বছর ধরে সেই ধারাবাহিকতার বদল ঘটেছে। সন্ত্রাসবাদে লাগাম পরানো হয়েছে। তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জি-২০-এর মতো আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাস্তা, সেতু, সুড়ঙ্গ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের জোয়ার এসেছে। ২০২২ সালে ১ কোটি ৮৮ লাখ পর্যটক জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমণ করেছেন।
সরকারি এই প্রচারের মূল বক্তব্য, উপত্যকার জনজীবন স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনা হলো, গত চার বছরে উপত্যকা থেকে ‘বিতাড়িত’ কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা (হিন্দু) ‘নিরাপত্তাহীনতার কারণে’ এখনো ঘরে ফিরতে রাজি নন। বিতাড়িত হিন্দু সরকারি কর্মীরা এখনো জম্মুসহ অন্যত্র শিবিরবাসী। ৭৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এলেও হোটেল ছাড়া অন্য কোনো শিল্পে কেউ লগ্নিতে উৎসাহ দেখায়নি।
উপত্যকায় বাণিজ্যিক মল ও সিনেমা হল খোলার কৃতিত্ব দাবি করেছে সরকার। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষী কমানোর কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। সরকারি হিসেবেই স্পষ্ট, গত চার বছরে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ৬৫৪টি। তাতে ১২৭ জওয়ান ও পুলিশের মৃত্যু হয়েছে। সাধারণ নাগরিক মারা গেছেন ১১৮ জন।