গাজা শহরের ভেতরে একটি বুলডোজারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক ইসরায়েলি
গাজা শহরের ভেতরে একটি বুলডোজারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক ইসরায়েলি

ইসরায়েলিদের ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে গাজায় বাড়িঘর ধ্বংস করছে সেনারা

গাজা উপত্যকায় ভারী যন্ত্রের সাহায্যে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের বেসামরিক লোকজন মাসে ৯ হাজার ডলার পর্যন্ত উপার্জন করছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১১ লাখ টাকা। গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য মার্কার–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও নাগরিক স্থাপনা পরিকল্পিতভাবে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এ কাজ করার জন্য জন্য বিভিন্ন ধরনের ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার করতে হয়। শুধু সেনারা নন, বেসামরিক ব্যক্তিরাও এসব যন্ত্রপাতি চালাচ্ছেন।

দ্য মার্কারের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন ভারী যন্ত্রচালক প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ২০০ শেকেল (প্রায় ৩৬০ মার্কিন ডলার) আয় করছেন। যন্ত্রের মালিককে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যে ভাড়া দেয়, তা থেকেই চালককে এ অর্থ পরিশোধ করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিদিন যন্ত্রের মালিককে ৫ হাজার শেকেল (প্রায় ১ হাজার ৫০০ ডলার) করে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া বেসরকারি ঠিকাদারেরা চাইলে দর-কষাকষির মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন হারে অর্থ আদায় করতে পারেন।

গাজায় একটি তিনতলা ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য একজন ঠিকাদার পান ২ হাজার ৫০০ শেকেল (প্রায় ৭৫০ মার্কিন ডলার)। আর যদি ভবনটি উঁচু হয়, তাহলে সেই অর্থ ৫ হাজার শেকেলে (প্রায় ১ হাজার ৫০০ ডলার) গিয়ে ঠেকে।

গাজায় ভারী যন্ত্র চালানো এক ইসরায়েলি নাগরিক সংবাদমাধ্যম দ্য মার্কারকে বলেন, ‘শুরুতে আমি শুধু অর্থের জন্য কাজটা করতাম। পরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য করতে থাকি। কাজটা খুব কষ্টকর আর অপ্রীতিকর। সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে কিছু করে না, ওরা শুধু যতটা বেশি সম্ভব ধ্বংস করতে চায়, তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না।’

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও নাগরিক স্থাপনা পরিকল্পিতভাবে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এ কাজ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার করতে হয়। শুধু সেনারা নন, বেসামরিক ব্যক্তিরাও এসব যন্ত্রপাতি চালাচ্ছেন।

ওই ইসরায়েলি আরও বলেন, ‘আমি ১ মাসে প্রায় ৩০ হাজার শেকেল (৯ হাজার ডলার) পর্যন্ত পারিশ্রমিক পাই। আমাকে একটা গাড়ি দেওয়া হয়েছে, আশকেলনে একটা বাসাও ভাড়া করে দেওয়া হয়েছে।’

দ্য মার্কারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় দ্রুত বাড়িঘর ধ্বংসের কাজ শেষ করতে উৎসাহ দেয়। গাজায় যত দ্রুত ভবন ভেঙে ফেলা যায়, যন্ত্রের মালিকদের আয় তত বেশি হয়।

গত কয়েক মাসে ভারী যন্ত্র চালানোর লোক খুঁজতে অনলাইনে চাকরির বিজ্ঞাপনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, আজকাল প্রতিটি সেনা কমান্ডার চান যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর পাশে যেন একজন দক্ষ যন্ত্রচালক আর একটি শক্তিশালী বুলডোজার থাকে।

সাধারণত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ডি-৯ নামের সাঁজোয়া বুলডোজার ব্যবহার করে থাকে। তবে চাহিদা বেশি হওয়ায় এখন তারা বেসরকারি মালিকানাধীন যন্ত্রও গাজায় নিয়ে আসছে।

একজন রিজার্ভ সেনা দ্য মার্কারকে বলেন, এই যন্ত্রগুলো (বেসরকারি মালিকানাধীন) সাঁজোয়া নয়। এগুলোকে রকেট বা স্নাইপার হামলা থেকে বাঁচাতে বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিকে ভাড়া করা হয়। তবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকাণ্ডে এসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না।

অর্থের লোভে ত্রাণকর্মীদের হত্যা

ইহুদি রাষ্ট্রটির সেনাবাহিনী ও ঠিকাদারেরা কতটা নৃশংস, নানা ঘটনায় সেসব উঠে এসেছে। গাজায় বেশি বেশি ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি ঠিকাদারেরা উন্মুখ হয়ে থাকেন। আর তাঁদের এমন আগ্রহের কারণে গাজায় যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ফিলিস্তিনি ত্রাণপ্রত্যাশীদের হত্যার ঘটনা ঘটছে।

হারেৎজ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে কয়েকজন ইসরায়েলি সেনার বরাত দিয়ে বলা হয়, বেসরকারি ঠিকাদারেরা ‘শেরিফের মতো’ আচরণ করছেন। তাঁরা গাজার যেকোনো জায়গায় ইচ্ছামতো ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন। তাঁদের নিরাপত্তা দিতে ইসরায়েলি সেনারা তাঁদের পাশে থাকেন।

যখন নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা এই সেনাদের কাছাকাছি চলে আসেন, তখন সেনারা গুলি ছোড়েন। সেনারা দাবি করেন, কাছাকাছি দূরত্বে চলে আসা এসব বেসামরিক নাগরিক ‘ঝুঁকি’ তৈরি করছেন।

ইসরায়েলি এক সেনা বলেন, তাঁরা তাঁদের ভাগ্য গড়ছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ না থাকার মানেই হলো আর্থিক ক্ষতি হওয়া। এ জন্য বাহিনীগুলো তাদের কাজ পাওয়া নিশ্চিত করে।

ইহুদি রাষ্ট্রের সেনারা আরও বলেন, প্রায়ই সেনারা ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের কাছে চলে যান এবং পরে তাঁদের ‘হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে বাড়তি পাঁচ হাজার শেকেল আয় করার অপেক্ষায় থাকা ঠিকাদারদের কাছে খাবারের খোঁজে আসা মানুষকে মেরে ফেলাকে সঠিক মনে হয়।

চলতি সপ্তাহে খান ইউনিসে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান চলাকালে হামাসের যোদ্ধারা এক ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করেন।

গাজায় একটি তিনতলা ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য একজন ঠিকাদার পান ২ হাজার ৫০০ শেকেল (প্রায় ৭৫০ মার্কিন ডলার)। আর যদি ভবনটি উঁচু হয়, তাহলে সেই অর্থ ৫ হাজার শেকেলে (প্রায় ১ হাজার ৫০০ ডলার) গিয়ে ঠেকে।

আব্রাহাম আজুলায় ওই সেনা ইৎজহার বসতি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন এবং ভারী যন্ত্র চালাতেন।

অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী ‘হিলটপ ইয়ুথ’-এর একটি চ্যাট গ্রুপ বলেছে, শত্রুপক্ষের বাড়ি ধ্বংস ও গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় আজুলায় সংঘর্ষের মধ্য পড়ে যান।

রিলিজিয়াস জায়োনিস্ট পার্টির কট্টর ডানপন্থী পার্লামেন্ট সদস্য তাজভি সুক্কোট পার্লামেন্টে এক বিতর্ক চলাকালে আজুলায়কে স্মরণ করেছেন।

সুক্কোট বলেন, আজুলায় রাফায় এসে ইসরায়েল রাষ্ট্রের নামে অনেক বাড়ি ধ্বংস করেছেন। তিনি জানতেন, হয়তো আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন না, যা সত্যিই ঘটেছে।

গত মে মাসে ইসরায়েলি বসতির আরেক বাসিন্দা ডেভিড লিবির প্রতিও শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন সুক্কোট। লিবি গাজা উপত্যকায় ভারী যন্ত্র চালানোর সময় নিহত হয়েছিলেন।

ইহুদিবাদীরা যে কতটা নৃশংস, সেটা উঠে এসেছে সুক্কোটের কথায়। তিনি বলেছিলেন, কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের বড় যে সাফল্যটি এসেছে, তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন লিবি।

সুক্কোট আরও বলেছিলেন, যন্ত্র চালকদের অনেকেই বসতি এলাকার মানুষ। সবচেয়ে পরিচিত ভারী যন্ত্রচালক হলেন আব্রাহাম জারবিব। অধিকৃত বেইত এল বসতি এলাকার বাসিন্দা তিনি। জারবিব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ভিডিওগুলোর জন্য বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। ওই সব ভিডিওতে তাঁকে গাজায় ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে দেখা যায়।

খান ইউনিস এলাকায় ধারণ করা সাম্প্রতিক এক ভিডিওতে তিনি বলেন, ‘এ গ্রাম নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা হাল ছাড়ব না।’

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন এক ফিলিস্তিনি

গত সপ্তাহে ইসরায়েলি সাংবাদিক উরি মিসগাভ বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন কাজ করা দুটি বেসামরিক প্রতিষ্ঠান গাজায় ভারী যন্ত্র চালানোর দায়িত্বে রয়েছে।

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাছে কয়েক ডজন করে ভারী যন্ত্র আছে। আর এসব যন্ত্র চালকদের নিয়োগ দেওয়া হয় ‘হিলটপ ইয়ুথ’-দের মধ্যে থেকে।

মিসগাভের তথ্য অনুযায়ী, এই দুটি প্রতিষ্ঠান গাজার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে ভাগ হয়ে কাজ করছে।

সাবেক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা গোলান ভাচ গাজার উত্তরাঞ্চলের কাজগুলো দেখভাল করেন। ইয়েহুদা ভাচ নামের এক ডিভিশন কমান্ডারের ভাই তিনি। নেতজারিম করিডরে অবৈধভাবে ‘হত্যা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা ও এটিকে কার্যকর করতে ভূমিকা রাখার অভিযোগে হিন্দ রজব ফাউন্ডেশন ওই ডিভিশন কমান্ডারকে ‘গাজার জল্লাদ’ বলে অভিহিত করেছে।

গত মাসে এই ফাউন্ডেশন ওই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে গাজায় সংঘটিত অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ করে।

গাজার দক্ষিণাঞ্চল দেখভাল করেন বেজালেল জিনি। তিনি ডেভিড জিনির ভাই। ডেভিড হলেন ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেতের প্রধান। তিনি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মনোনীত বিতর্কিত প্রার্থী।