
১৯৭৭ সালে প্রথম কোনো আরব নেতা হিসেবে ইসরায়েল সফর করেছিলেন মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। এক বছর পর ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন এ নেতা। এর জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে নিহত হন সাদাত। মিসরের প্রয়াত এ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আজকের ফিরে দেখা।
৪৪ বছর আগের কথা। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মিসরের যুদ্ধজয়ের বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে কায়রোয় একটি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত সে কুচকাওয়াজ পরিদর্শনে যান। মিসরীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন বিপথগামী সদস্য সেখানে ওঁৎ পেতে ছিলেন।
কুচকাওয়াজে সবাই যখন আকাশে ফ্লাইপাস্ট দেখতে ব্যস্ত, তখনই আনোয়ার সাদাতের কাছাকাছি পৌঁছে যান ওই সেনারা। এরপর গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে তাঁরা সাদাতকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। সেখানে উপস্থিত মিসরের সরকারি কর্মকর্তাদের নিশানা করেও গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। সাদাতকে চারবার গুলি করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। ওই হামলায় আরও ১০ জন নিহত হন। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবরের ঘটনা এটি।
আনোয়ার সাদাতের ওপর হামলা হতে পারে বলে আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন স্ত্রী জেহান সাদাত। বিবিসির উইটনেস হিস্ট্রিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মূলত আনোয়ার সাদাত যেদিন ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেন, সেদিন থেকেই স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছিল।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের বার্ষিকী উদ্যাপনের প্রসঙ্গ টেনে জেহান বলেন, ‘সেই দিনটা ছিল তাঁর (আনোয়ার সাদাত) কাছে খুবই প্রিয় একটি দিন। এ দিনটিকে নিয়ে তিনি গর্ব করতেন। আমি সেদিন তাঁকে বুলেট–প্রতিরোধী বর্ম পরতে বললাম; কিন্তু তিনি আমার কথা শুনলেন না। তিনি বললেন, বুলেট তো আমার মাথায়ও লাগতে পারে। তাহলে কি আমাকে মাথায়ও কিছু পরতে হবে? নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর যেন কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। কোনো কিছু না পরেই তিনি চলে গেলেন।’
আনোয়ার সাদাতের ওপর হামলা হতে পারে বলে আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন স্ত্রী জেহান সাদাত। বিবিসির উইটনেস হিস্ট্রিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, মূলত আনোয়ার সাদাত যেদিন ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেন, সেদিন থেকেই স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছিল।
জেহান সাদাত নিজেও ওই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আনোয়ার সাদাত যে জায়গাটিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তার থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরত্বে অবস্থান করছিলেন তিনি।
আনোয়ার সাদাতের ভাইয়ের ছেলে তালাত সাদাতও ২০১১ সালে সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ঘটনার দিন তাঁর চাচা ভেবেছিলেন, হামলাকারীরা কুচকাওয়াজেরই অংশ। তাই তিনি স্যালুটের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আর তখনই ওই সেনাসদস্যরা তাঁকে গুলি করেন।
তালাত আরও বলেছিলেন, তাঁর চাচা কখনো বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরতেন না। তিনি সব সময় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতেন, ‘আমি আমার সন্তানদের মধ্যেই আছি।’
১৯১৮ সালে মিসরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় আনোয়ার সাদাতের। তাঁর ভাই-বোনের সংখ্যা ১৩। ১৯৩৮ সালে কায়রো মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক করেন সাদাত। এরপর মিসরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কর্মজীবনের শুরুতে তাঁকে সুদানে নিযুক্ত করা হয়। সেখানে জামাল আবদেল নাসের তাঁর সহকর্মী ছিলেন। এ নাসের পরবর্তী সময়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
সাদাত ও নাসের আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁরা এর নাম দেন ‘ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট’। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মিসরকে মুক্ত করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি ব্রিটিশ বাহিনীকে উৎখাত করতে জার্মানির সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা করেন। ১৯৪২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই বছর পর মুক্তি পান সাদাত। তবে আবার ১৯৪৬ সালে আটক হন। ব্রিটিশপন্থী এক মন্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তখন। ১৯৪৮ সালে এ অভিযোগ থেকে খালাস পান সাদাত।
মিসরীয় সেনাবাহিনীর একটি ছোট দল এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ওই সেনারা চরমপন্থী ইসলামি গোষ্ঠী ‘ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা সাদাতের নীতি, বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রচেষ্টার বিরোধী ছিলেন। হামলাকারীদের নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট খালেদ ইসলামবুলি।
কারামুক্ত হওয়ার পর কিছুদিন সাধারণ জীবনযাপন করেন সাদাত। এরপর আবারও ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন। তত দিনে এর সদস্য সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে গেছে। ১৯৫২ সালে রাজা প্রথম ফারুককে উৎখাতে পরিচালিত অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন সাদাত।
এরপর মিসরের নতুন সরকারের প্রেসিডেন্ট হন নাসের। আর সাদাত সরকারের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৭ সালে মিসর-ইসরায়েলের মধ্যে ছয় দিনের যুদ্ধ চলাকালে সাদাত সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সহযোগিতা চান। তবে তাতে তিনি সাড়া পাননি। মিসরের তখন ব্যাপক পরাজয় হয়। তাদের বিমানবাহিনীর বড় ধরনের ক্ষতি হয় এবং আক্রমণের সক্ষমতার একটি বড় অংশই নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি তাদের সিনাই উপত্যকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও হারাতে হয়েছিল।
১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের মারা যান। তখন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সাদাত। নাসেরের মৃত্যুর পর সাদাত তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে ইহুদিদের ‘ইয়ম কিপুর’-এর ছুটির দিনে মিসর ও সিরিয়ার সেনারা আকস্মিকভাবে হামলা চালায়। সিনাই উপত্যকায় মিসরীয় সেনাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সামরিক সাফল্য অর্জন করতে দেখে ইসরায়েলিরা হতবাক হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলি বাহিনীকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার পর যুদ্ধের সে স্রোত আরবদের প্রতিকূলে যেতে শুরু করে।
ওই যুদ্ধের পর মিসর দুর্বল অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিবাদের ঘটনা সামলাতে হিমশিম খেতে থাকে। সাদাত তখন সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর মনে হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মিসরের জন্য ভালো কিছু হতে পারে।
মিসরের স্বাধীনতা অর্জন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আনোয়ার সাদাতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৭-৭৮ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে করা তার বিতর্কিত শান্তিচুক্তি তাঁকে মধ্যপ্রাচ্যের চরমপন্থীদের শত্রুতে পরিণত করে। এ ছাড়া অসুস্থ ইরানের শাহকে বিচারের মুখোমুখি হতে ইরানে ফেরত না পাঠানোর কারণে সাদাত অনেকের ক্ষোভের কারণ হন।
আনোয়ার সাদাত ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলে যান। সেটিই ছিল কোনো আরব নেতার প্রথম ইসরায়েল সফর। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের কয়েক বছরের মাথায় তাঁর এ সফরকে আরব নেতারা ভালোভাবে নেননি। বিরোধিতা উপেক্ষা করেই জেরুজালেম সফর করেন সাদাত।
পরের বছর ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের ক্যাম্প ডেভিড সফর করেন সাদাত। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ও তাঁর দলবলের সঙ্গে সাদাতের ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
অবশেষে আলোচনার মধ্য দিয়ে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে সম্মত হয় দুই পক্ষ। তবে এর জন্য ফিলিস্তিনিদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়, ইসরায়েল মিসরকে সিনাই উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেবে। তার বিনিময়ে মিসর ইহুদি রাষ্ট্রটিকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেবে ও পুরোপুরি কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে। এ ছাড়া সুয়েজ খাল দিয়ে মুক্তভাবে ইসরায়েলি জাহাজ চলাচলের সুযোগ দেবে মিসর।
ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে চলা যুদ্ধাবস্থার অবসান হয়।
ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনা প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৮ সালে আনোয়ার সাদাতকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনও শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
নোবেল পুরস্কার নেওয়ার সময় বক্তব্যে সাদাত বলেছিলেন, ‘আমার মধ্য দিয়ে চিরন্তন মিসরই প্রতিধ্বনিত হয়েছে—চলুন, যুদ্ধের ইতি টানি। ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে নতুনভাবে জীবন গড়ে তুলি।’
তবে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাহবা দিলেও আরব বিশ্বে এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়। মিসরের অভ্যন্তরে অনেকে ইসরায়েলের সঙ্গে এ শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ, দেড় হাজার ইসলামিক জিহাদ সদস্যকে গ্রেপ্তার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় দমননীতি, আর অর্থনৈতিক মন্দা—সব মিলিয়ে সাদাতের বিরুদ্ধে দেশে তীব্র ক্ষোভ জমা হতে থাকে।
মিসরীয় সেনাবাহিনীর একটি ছোট দল এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ওই সেনারা চরমপন্থী ইসলামি গোষ্ঠী ‘ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা সাদাতের নীতি, বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রচেষ্টার বিরোধী ছিলেন। হামলাকারীদের নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট খালেদ ইসলামবুলি।
হিস্ট্রি ডট কমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাদাত হত্যার ঘটনায় ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই অনুতপ্ত ছিলেন না। তাঁরা গর্বের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেন। ইসলামবুলি এবং আরও চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর ১৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মিসরে ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ ছিল অনেক বেশি চরমপন্থী একটি সংগঠন। তাদের লক্ষ্য ছিল মিসরের প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং মিসরকে ইসলামি আমিরাতে পরিণত করা। আনোয়ার সাদাতকে হত্যার সময় সংগঠনটির নেতা এবং প্রধান কৌশল প্রণয়নকারী ছিলেন আবুদ আল জুমার। তাঁকে সাদাত হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।
আয়মান আল জাওয়াহিরি ছিলেন আবুদ আল জুমার সহযোগী। আল জুমার কারাগারে যাওয়ার পর জাওয়াহিরি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পরে জাওয়াহিরিই আল–কায়েদা নেতা হয়েছিলেন। প্রায় ৩০ বছর কারাগারে থাকার পর মুক্তি পান জুমার।
২০২১ সালের ৫ অক্টোবর আরব নিউজে লেবাননের অর্থনীতিবিদ ও নিউইয়র্কে লেবানিজ আমেরিকান ইউনিভার্সিটির নির্বাহী পরিচালক নাদিম শেহাদির একটি কলাম প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭৭ সালের ১৯ নভেম্বর জেরুজালেম ঐতিহাসিক সফরের মধ্য দিয়ে আনোয়ার সাদাত বিশ্বকে এমনকি নিজের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাকে চমকে দিয়েছিলেন। এটি ছিল একটি সাহসী ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, যার হাত ধরে এক বছর পর ক্যাম্প ডেভিডে মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তি হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এর জন্য তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে।’
এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কয়েকটি কারণ আছে বলে উল্লেখ করেন নাদিম শেহাদি। তবে তিনি মনে করেন, এগুলোর মধ্যে দুটি কারণ বেশ প্রাসঙ্গিক। এর একটি হলো সাদাত তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের নীতিগুলো থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। তিনি নীতিমালায় বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস করেছিলেন। এর নাম দিয়েছিলেন ‘ইনফিতাহ’ বা ‘দেশকে উন্মুক্ত করা’।
আনোয়ার সাদাত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী থেকে দূরে সরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঘেঁষছিলেন। আর এতেই জামাল নাসেরপন্থীরা আনোয়ার সাদাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
আরেকটি কারণ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সাদাতের সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, নির্বাসিত ব্যক্তিদের দেশে ফেরার সুযোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রকাশনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য সীমিত আকারে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
নাদিম শেহাদি মনে করেন, দেশকে উদারীকরণ এবং দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে হয়তো সাদাত এসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন; কিন্তু নাসেরপন্থীদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছিলেন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তারা অনুপ্রবেশ করেন এবং ঘাতকেরা সেই কুচকাওয়াজের অংশ হওয়ার সুযোগ পান।
২০১১ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুমার দাবি করেছিলেন, তিনি অস্ত্র দিয়েছিলেন, সাদাতকে হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন, তবে হত্যার নির্দেশ তিনি দেননি।
এনবিসিকে জুমার আরও বলেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তিই সাদাতকে হত্যার একমাত্র কারণ নয়, তাঁকে শরিয়া আইনবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এ ছাড়া স্বৈরশাসনের ধারণা সামনে এনে সাদাত জনগণের অধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন বলেও মনে করত ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ।
সাদাতের হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় বসেন। তিনি পরের তিন দশক মিসরের শাসনক্ষমতায় ছিলেন।
এনবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুমার বলেছিলেন, সাদাতকে হত্যার জন্য তিনি একদমই অনুতপ্ত নন। তবে তাঁর একমাত্র আক্ষেপের জায়গাটি হলো সাদাতকে হত্যা করার কারণে হোসনি মুবারক ক্ষমতায় বসে গেছেন। তাঁর মতে, হুসনি মোবারকের চেয়ে সাদাত হাজার গুণ ভালো ছিলেন।
তথ্যসূত্র: এনবিসি, আল–জাজিরা, বিবিসি, এমএসএন