তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কড়া নিন্দা না জানিয়ে কী অর্জন করতে চাইছেন এরদোয়ান

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো হামলার বিষয়ে তুরস্ক এখন পর্যন্ত সরাসরি নিন্দা জানায়নি। অথচ ইরানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এবং মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের কয়েকটি দেশ এই হামলাকে বিপজ্জনক উসকানি হিসেবে দেখছে। ইরানে ইসরায়েলি হামলার কড়া সমালোচনাও করেছে এসব দেশ।

গত শনিবার রাতে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়াটাই এর উদ্দেশ্য ছিল।

ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি বিশ্ববাসীকে বলতে চাই, এই হামলাগুলোর মধ্য দিয়ে অসাধারণ রকমের সামরিক সাফল্য এসেছে। ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো পুরোপুরি এবং চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।’

ট্রাম্প আরও বলেন, তেহরানের উচিত এখন শান্তি স্থাপন করা। ইরান শান্তিপূর্ণ অবস্থানে না এলে হামলা আরও জোরদার করার হুমকি দেন তিনি।

ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘এখন হয় শান্তি আসবে, না হয় ইরানের জন্য এমন এক ট্র্যাজেডি তৈরি হবে, যা গত আট দিনে দেখা ঘটনাগুলোর চেয়েও ভয়ংকর হবে।’

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কয়েক ঘণ্টা পর তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়, এসব হামলা গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

আঙ্কারা দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের বিরোধিতা করে এলেও তারা সব সময় কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখজনক হলো ২০১০ সালে তুরস্ক ও ব্রাজিল যৌথভাবে একটি পারমাণবিক জ্বালানি বিনিময় চুক্তির মধ্যস্থতা করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল উত্তেজনা কমানো।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ‘আমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এভাবে চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাত বৈশ্বিক রূপ নিতে পারে। এই ভয়ংকর পরিস্থিতির আশঙ্কা বাস্তব হোক, তা আমরা চাই না।’

অথচ তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই মেপে মেপে বলা কথাগুলো এক দিন আগে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের করা মন্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইরানে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে ওই মন্তব্য করেছিলেন এরদোয়ান। ইরানে ইসরায়েলের হামলাকে ‘দস্যুবৃত্তি’ আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি।

আঙ্কারা দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের বিরোধিতা করে এলেও তারা সব সময় কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখজনক হলো, ২০১০ সালে তুরস্ক ও ব্রাজিল যৌথভাবে একটি পারমাণবিক জ্বালানি বিনিময় চুক্তির মধ্যস্থতা করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল উত্তেজনা কমানো।

গতকাল রোববার তুরস্কের চিন্তক প্রতিষ্ঠান সেটা-এর নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ এবং দেশটির সরকারের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক পরিষদের সদস্য মুরাত ইয়েসিলতাস বলেন, ‘ইরানের কথিত পারমাণবিক প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনের চেষ্টাকে দেশটির নেতারা আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন বলে যুক্তি দেখাচ্ছেন। তুরস্কের দৃষ্টিতে এ এক বিপজ্জনক বাজি, যা পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করতে পারে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধিতা মানে এই নয় যে তুরস্ক ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি নীরব সমর্থন দিচ্ছে।’

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ

তুরস্ক বলছে, ইসরায়েল যে সম্প্রতি ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছে, তার পেছনে তেহরানের কোনো উসকানি ছিল না। কারণ, অনেক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার কেউই মনে করে না যে ইরান এখন পারমাণবিক বোমা বানাতে যাচ্ছে।

এতেই বোঝা যায়, তুরস্কের কর্মকর্তারা কেন এত দ্রুত ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, এই হামলাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। এমনকি বড় আকারে যুদ্ধও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে গাজা, লেবানন আর সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলার পর ইরানের ওপর এ হামলাকে কেন্দ্র করে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম নূর নিউজ দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানিয়েছে, ১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৩০ জন নিহত এবং প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছেন। আর ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, ইরানের হামলায় তাঁদের দেশে কমপক্ষে ২৫ জন নিহত এবং কয়েক শ মানুষ আহত হয়েছেন।

এরদোয়ান উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং ট্রাম্পসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন।

ইরানে নজিরবিহীন মার্কিন অভিযানে সাতটি স্টেলথ বি-২ বোমারু বিমান অংশ নেয়  

যদিও এই ফোনালাপের মাধ্যমে এরদোয়ান একজন সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনার স্থান হিসেবে ইস্তাম্বুলের নাম প্রস্তাব করেছেন তিনি। ট্রাম্পের কঠোর সমালোচনা না করে এরদোয়ান তাঁর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছেন। এর আগে এই সম্পর্কের বদৌলতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার প্রশাসনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ট্রাম্পকে রাজি করাতে পেরেছিলেন তিনি।

অ্যাক্সিওসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে তুরস্কের কর্মকর্তারা মিডল ইস্ট আই-কে বলেন, গত সপ্তাহে এরদোয়ান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে ইস্তাম্বুলে পাঠানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে রাজি করিয়েছিলেন। সেখানে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ভ্যান্স ও উইটকফের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এমনকি ট্রাম্প নিজেও আলোচনায় অংশ নিতে পারেন বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল।

‘ইরানের কথিত পারমাণবিক প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনের চেষ্টাকে দেশটির নেতারা আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন বলে যুক্তি দেখাচ্ছেন। তুরস্কের দৃষ্টিতে এ এক বিপজ্জনক বাজি, যা পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করতে পারে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধিতা মানে এই নয় যে তুরস্ক ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি নীরব সমর্থন দিচ্ছে।’
মুরাত ইয়েসিলতাস, নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ

তবে শেষ পর্যন্ত সেই বৈঠক হয়নি। তুর্কি কর্মকর্তারা বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে যোগাযোগ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সর্বশেষ বিবৃতিটিতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ইচ্ছার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনার আয়োজন করতে তুরস্ক আগ্রহী।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিরোধ সমাধানের একমাত্র পথ হলো আলোচনা। তুরস্ক এ বিষয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত এবং গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চায়।’

যদিও এরদোয়ান কখনো কখনো উত্তেজনাপূর্ণ ভাষায় কথা বলেন, তবে বাস্তবে তিনি আঞ্চলিক সংকটগুলোতে অনেকটাই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নেন। তিনি সরাসরি কোনো পক্ষ না নিয়ে তুরস্ককে এমন এক অবস্থানে রাখতে চান, যাতে দেশটি কৌশলগতভাবে লাভবান হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চলমান বিরোধের একমাত্র সমাধান হচ্ছে আলোচনা। তুরস্ক এ বিষয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত এবং গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চায়।’

তবে এরদোয়ান মাঝেমধ্যে কঠোর বক্তব্য দিলেও বাস্তবে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাত পরিস্থিতিতে হিসাব–নিকাশ করে পদক্ষেপ নেন। সরাসরি কোনো পক্ষ না নিয়ে তুরস্ককে কীভাবে কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখা যায়, সে চেষ্টা করেন তিনি।

ন্যাটোতে তুরস্কের সদস্যপদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় মিত্র ও প্রতিপক্ষ—দুই পক্ষের সঙ্গেই আলোচনার মাধ্যমে কৌশলগত লক্ষ্যপূরণের সুযোগ পায় আঙ্কারা।

তুর্কি বিশ্লেষক মুরাত ইয়েসিলতাস মনে করেন, ইসরায়েল-ইরান সংঘাত নিয়ে তুরস্ক যে অবস্থান নিয়েছে, তা শুধু স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়নি।

মুরাত বলেন, ‘ঝুঁকিগুলো কাল্পনিক নয়। এসব ঝুঁকির মধ্যে আছে তুরস্কের ভূখণ্ডগত নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা এবং জনমিতিগত স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে সরাসরি হুমকি।’