ইসলামাবাদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় আগুন ধরে যাওয়া একটি গাড়িতে পানি ছিটানো হচ্ছে। ১১ নভেম্বর, ২০২৫
ইসলামাবাদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় আগুন ধরে যাওয়া একটি গাড়িতে পানি ছিটানো হচ্ছে। ১১ নভেম্বর, ২০২৫

‘মাথার ওপর যেন ছাদ ভেঙে পড়ছে’—ইসলামাবাদে হামলা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী

ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর সাড়ে ১২টা ছুঁই ছুঁই। ইসলামাবাদের তরুণ আইনজীবী খালিদ খান বন্ধু ফাওয়াদ খানকে নিয়ে খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছিলেন। বসেছিলেন ইসলামাবাদের জেলা আদালত প্রাঙ্গণের ক্যাফেটেরিয়ায়।

হঠাৎ বিকট শব্দ। বিস্ফোরণের ধাক্কায় ক্যাফেটেরিয়াসহ পুরো আদালত প্রাঙ্গণ কেঁপে ওঠে। এর দুই ঘণ্টা পর আদালত প্রাঙ্গণের বাইরে খালিদের সঙ্গে কথা হয় আল-জাজিরার। তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমার মনে হয়েছিল, মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়বে।’

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ওই আদালতের বাইরে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া সরকারি তথ্য অনুযায়ী, হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত ও ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের অনেকের অবস্থা গুরুতর। একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আদালত প্রাঙ্গণে ঢোকার প্রবেশমুখে সড়কে নিজেকে উড়িয়ে দেন।

হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত এবং ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের অনেকের অবস্থাই গুরুতর। একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আদালত প্রাঙ্গণে ঢোকার প্রবেশমুখে সড়কে নিজেকে উড়িয়ে দেন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ হামলার দায় ভারতের ওপর চাপিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে পরিচালিত ভারত–সমর্থিত প্রক্সি বাহিনী এ হামলা চালিয়েছে। ভারত এ অভিযোগ ‘স্পষ্টভাবে’ প্রত্যাখ্যান করেছে।

পাকিস্তানে এ হামলার ঠিক আগের দিন সোমবার সন্ধ্যায় ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে একটি মেট্রো স্টেশনের কাছে গাড়ি বিস্ফোরণে অন্তত ১৩ জন নিহত হন।

ইসলামাবাদে হামলার পর গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ইসলামাবাদ সরকার সে দেশে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা থেকে জনগণের মনযোগ সরাতে চেষ্টা করছে।

আল-জাজিরা বলেছে, এ বক্তব্যে তিনি (জয়সোয়াল) হয়তো পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আলোচিত ২৭তম সংবিধান সংশোধনীর বিষয়কে ইঙ্গিত করছেন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাস্তব পরিস্থিতি খুব ভালো করে জানে। পাকিস্তান মরিয়া হয়ে তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের এ কৌশল কাজে দেবে না।
রণধীর জয়সোয়াল, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র

রণধীর জয়সোয়াল বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাস্তব পরিস্থিতি খুব ভালো করে জানে। পাকিস্তান মরিয়া হয়ে তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের এ কৌশল কাজে দেবে না।

পাকিস্তানের সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী প্রস্তাবে দেশটির সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দায়মুক্তির প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া একটি সমান্তরাল ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত গঠনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অনেকের ভয়, এতে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট দুর্বল হয়ে পড়বে।

পাকিস্তানের অনেক সমাজকর্মী, বর্তমান বিচারক এবং বিরোধী দলগুলো ২৭তম সংশোধনী প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

গতকালের আত্মঘাতী হামলাটি হয়েছে একটি জেলা আদালত প্রাঙ্গণে। আশপাশের আবাসিক এলাকা ও অফিস ভবন থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বিস্ফোরণের সময় আদালত প্রাঙ্গণে প্রায় দুই হাজার মানুষ ছিল। তাঁদের মধ্যে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও আদালতের কর্মীরাও ছিলেন। বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে আদালত ভবনের কয়েকটি জানালা ভেঙে যায়। মৃতদেহের খণ্ডিত অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।

বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, একটি বিধ্বস্ত গাড়িতে আগুন জ্বলছে এবং কালো ধোঁয়া আকাশে উঠে যাচ্ছে।

অন্যান্য ভিডিওতে দেখা যায়, আইনজীবীরা সড়কে পড়ে থাকা রক্তাক্ত মানুষদের সাহায্য করতে ছুটে আসছেন। নিরাপত্তারক্ষীরা ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বিস্ফোরণের সময় আদালত প্রাঙ্গণে প্রায় দুই হাজার মানুষ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও আদালতকর্মীরাও ছিলেন। বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে আদালত ভবনের কয়েকটি জানালা ভেঙে যায়। মৃতদেহের খণ্ডিত অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।

ওই সময় ঘটনাস্থলে থাকা ৫২ বছর বয়সী আইনজীবী মুহাম্মদ শেহজাদ ভুট্ট বলেন, বিস্ফোরণকালে তিনি ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যাচ্ছিলেন।

আল-জাজিরাকে শেহজাদ বলেন, ‘চারদিকে চরম হট্টগোল ছিল, আতঙ্কে সবাই ছুটোছুটি করছিলেন। বেশির ভাগ মানুষ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মূল ফটকে এত ভিড় জমে গিয়েছিল যে অনেকে বের হতে না পেরে ভবনের ভেতরে চলে যান।’

প্রতিদিনের মতো সকালেই আদালতে এসেছিলেন শেহজাদ ভুট্ট। বলেন, প্রতিদিন যেমন নিরাপত্তা তল্লাশি করে ভেতর ঢুকতে দেওয়া হয়, সেদিনও তেমনই ছিল। তবে তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছে শুনেছেন, সেদিন নাকি বাড়তি নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়েছিল।

গতকাল বাড়তি নিরাপত্তা তল্লাশির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তরুণ আইনজীবী খালিদ। কোয়েটার বাসিন্দা হলেও পাঁচ বছর ধরে তিনি ইসলামাবাদে কাজ করছেন।

প্রতিদিনের মতো নিরাপত্তা তল্লাশি করে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। তবে পরে সহকর্মীদের কাছে শুনেছি, সেদিন নাকি বাড়তি নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়েছিল।
শেহজাদ ভুট্ট, আইনজীবী

খালিদ বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) সকালে যখন ফাওয়াদ আর আমি আদালত প্রাঙ্গণে পৌঁছালাম, তখন প্রবেশদ্বারে বাড়তি নিরাপত্তা তল্লাশি চলছিল। তাই আমাদের ভেতরে ঢুকতে একটু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। তবে এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ ছিল না। শুধু আমাদের মনে হয়েছিল, হয়তো কোনো ভিআইপি বা কোনো প্রতিনিধিদল আদালতে আসছে।’

এ হামলায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। তাঁর মধ্যে একজন আইনজীবীও রয়েছেন। তবে খালিদ ও ফাওয়াদ বলেছেন, পরদিন কাজে আসা নিয়ে তাঁরা ভীত নন।

খালিদ বলেন, ‘আমাদের এসব (নৃশংসতা) অনেকবার দেখতে হয়েছে। এসবে আমরা আর ভয় পাই না।’

পাকিস্তান তেহরিক–ই–তালেবান (টিটিপি) হামলার দায় স্বীকার করেছে।