
সবুজ অরণ্যে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির মতোই সহজ-সরলভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেটির জন্ম। ছেলেটিকে প্রকৃতি খুব কাছে টানতো। তাইতো ছেলেটি গভীর রাতে ঘর থেকে বের হয়ে একাকী বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতো। গাছের ডালে রাত জাগা একলা সঙ্গীবিহীন পাখিটির বিরহ-বেদনা ছেলেটির হৃদয় ছুঁয়ে যেতো।
শরতের মেঘমুক্ত আকাশে কত শতবার তারা গণনার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল ছেলেটি। হঠাৎ ঝরে পড়া তারাগুলো তাকে ভীষণ কষ্ট দিত। রবি ঠাকুরের ছুটি গল্প পড়তে পড়তে মনের অজান্তেই ছেলেটি ফটিকের কষ্টে কতবার যে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছিল, তার হিসাব নেই। হৈমন্তী, ফটিক, কুবের, লাবণ্য, দীপাবলী, জোহুরার মতো বেদনাদায়ক চরিত্রগুলো ছেলেটির দুনয়নকে বারে বারে অশ্রুসিক্ত করে তুলত।
অন্য আট-দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ছেলেটির পরিবারেও সব সময় অভাব-অনটন লেগেই থাকত। সাধ্য না থাকলেও সাধের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু সেই সব সাধ খুব কম সময়ই আলোর মুখ দেখতে।
ছেলেটি বছরের বেশির ভাগ সময় তার বড় ভাইদের পুরোনো শার্ট-প্যান্ট পরেই কাটাত, তাই দুটি ঈদেই ছিল পরিবার থেকে নতুন জামা পাওয়ার সুযোগ। কিন্তু একজন সৎ, আদর্শবান বাবার পক্ষে একান্নবর্তী পরিবারের সবাইকে ঈদে নতুন জামা কিনে দেওয়া সম্ভব হতো না। বাবার সীমিত আয় দিয়েই মাকে পুরো মাস সংসার চালাতে হতো। সারা বছর কোনো মতে কাটলেও ঈদের বাড়তি খরচ মাকে বেকায়দায় ফেলে দিত।
সহপাঠী ও বন্ধুরা ইতিমধ্যেই ঈদের নতুন জামা কিনে ফেলেছে, কিন্তু ছেলেটির এখনো ঈদের নতুন জামা কেনা হলো না। বাবা মাসের শেষে মাইনে পাবেন, তারপর মানি ড্রাফট করবেন, আর সেই টাকা দিয়ে মা সবাইকে ঈদের জামা কিনে দেবেন।
তাই প্রতিদিন ছেলেটি পোস্ট অফিসে বাবার চিঠির অপেক্ষায় থাকত। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত চিঠি আসল। তখন মাত্র কয়েক দিন বাকি ঈদের, তাই শেষ মুহূর্তে হকার্স মার্কেট মায়ের সঙ্গে জামা কিনতে যাওয়া। সীমিত বাজেটে মোটামুটি সবার জন্য ঈদের নতুন জামা কেনা-কাটা হলো। কিন্তু মা নিজের জন্য কোনো কিছুই কিনলেন না। তা দেখে ছেলেটি মাকে প্রশ্ন করল, ‘মা তুমি তোমার জন্য নতুন কাপড় কিনবে না?’
উত্তরে মা বললেন—‘গত ঈদের কাপড়টা এখনো ভালো আছে, মাত্র তো কয়েকটা দিন পরেছি, এই ঈদেও আমি সেই কাপড়টি পরব।’
সবাইকে নতুন জামা কিনে দিয়ে মা খুশি থাকলেন। কিন্তু মায়ের নতুন কাপড় না কেনা সেই ছোট্ট ছেলেটিকে সেদিন খুশি করতে পারেনি। মনে মনে ছোট্ট ছেলেটি শপথ করেছিল, একদিন সে অনেক বড় হবে। তখন মাকে অনেক দামি শাড়ি কিনে দেবে এবং মা-বাবাকে আর কষ্ট করতে দেবে না।
সেই ছোট্ট ছেলেটি একদিন বড় হয়। অনেক টাকা-পয়সা উপার্জন করতে শুরু করে। মনে মনে ভাবে, এখন থেকে আর বাবা-মাকে কষ্ট করতে দেবে না।
বছর ঘুরে আবারও এল ঈদ। ছেলেটি তার বাবার ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা পাঠাল আর বাবাকে বলল—‘মাকে নিয়ে আপনি মার্কেটে যাবেন, আপনাদের পছন্দের শাড়ি ও পাঞ্জাবি কিনে নেবেন এবং অন্যদেরও তাদের পছন্দ মতন জামা-কাপড় কিনে দেবেন’।
পরেরটা শুধুই বিষাদের করুন ইতিহাস। ছেলেটির বাবা ঈদের কয়েক দিন আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আর ঈদের দিন সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান!
অবশিষ্ট থাকলেন মা। মায়ের বুকে মাথা লুকিয়ে বাবা হারানোর কষ্ট ভুলতে চাইত ছেলেটি। মায়ের সঙ্গে ঈদ করবে, এই ভেবে ছেলেটি সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে মমতাময়ী মায়ের কাছে ছুটে যায়। ছোট্ট বেলার স্মৃতি এখনো ছেলেটিকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই মায়ের জন্য ছয় হাজার টাকা দিয়ে জামদানি কিনে আনল ছেলেটি।
মায়ের সামনে শাড়িটি খুলে ছেলেটি বলল,
-মা দেখো তো, শাড়িটি কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
-মা জিজ্ঞাসা করল কত টাকা নিল শাড়িটির দাম,
-ছেলেটি উত্তর দিল ছয় হাজার টাকা।
তখন ছেলেটির মা বললেন, আমার তো অনেক শাড়ি পড়ে আছে, আমাকে এত টাকার শাড়ি না দিয়ে যদি ৫০০ টাকার ১২টি কাপড় ১২ জন গরিবকে দেওয়া হতো তবে আরও ভালো হতো।
তারপর আবার সেই ঈদের আগের দিন। সে এক করুন, বেদনাময়, বিষাদের দিন। ছেলেটির জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন। আবারও সবাইকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে মমতাময়ী মা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তবে ছেলেটির কেনা শখের জামদানি পরে নয় বরং মাত্র ৫০০ টাকার সাদা কাফনের কাপড় পরে চির বিদায় নিলেন চির দুঃখিনী মা!
এভাবেই লেখা হয় মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জীবনের করুন ইতিহাস। যেখানে মা-বাবারা সারা জীবন সন্তানদের সুখের জন্য নিজেদের সুখ-শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে দেয়। কিন্তু যখন তাদের সুখের সময় আসে, তখন আর তাদের কপালে সুখ সয় না।
সত্যি, কিছু ত্যাগ ও কিছু ভালোবাসার ঋণ আমাদের কখনই শোধ করা হয়ে উঠে না।
ছেলেটি এক ঈদে তার বাবাকে হারিয়েছে এবং আরেক ঈদে মাকে হারিয়েছে। তাই ঈদ মানে সবার কাছে আনন্দ হলেও ছেলেটির কাছে ঈদ মানে এক দুঃস্বপ্ন, দুঃসহ স্মৃতি, এক ট্র্যাজেডি, বিচ্ছেদ বেদনার এক বিষণ্ন প্রহর এবং বুকের গহিনে নীরবে রক্তক্ষরণ!