ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জেফরি এপস্টেইন
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জেফরি এপস্টেইন

‘দারুণ লোক’ থেকে ‘প্রতারক’—ট্রাম্প-এপস্টেইন সম্পর্কের উত্থান-পতন কীভাবে

একজন ছিলেন নিউইয়র্কের কুখ্যাত ধনকুবের, যাঁর নাম শুনলে আজও কেঁপে ওঠে উচ্চবিত্ত মহল। আরেকজন ওই সময়ের হোটেল ও ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের নির্মাতা, এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্ট। জেফরি এপস্টেইন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প—দুজনের বন্ধুত্ব নিয়ে নতুন করে আলোচনা–সমালোচনা শুরু হয়েছে। নগ্ন চিত্র আঁকা জন্মদিনের চিঠি, পার্টিতে হাস্যোজ্জ্বল দৃশ্য, ব্যক্তিগত জেট ভ্রমণ—সব মিলে তাঁদের বন্ধুত্ব যেন হলিউডি স্ক্রিপ্ট!

তবে গল্পটা এখানেই থেমে নেই। এখন ট্রাম্প বলছেন, সব ভুয়া। সেই সঙ্গে করেছেন হাজার কোটি ডলারের মানহানি মামলা। দুজনের বন্ধুত্বের শুরু কোথায় আর ফাটল ধরল কখন—সব মিলিয়ে এখন এ সম্পর্ক মার্কিন রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত এক বিতর্ক।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ট্রাম্পের সঙ্গে কুখ্যাত নারী নিপীড়নকারী মার্কিন ধনকুবের এপস্টেইনের বন্ধুত্ব নিয়ে বিস্ফোরক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটি গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০০৩ সালে তখনকার আবাসন ব্যবসায়ী ট্রাম্প এপস্টেইনকে তাঁর জন্মদিনে ওই আপত্তিকর চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে একজন নগ্ন নারীর অবয়ব আঁকা ছিল। চিঠিতে তাঁদের দুজনের মধ্যে একটি ‘গোপন বিষয়’ থাকার উল্লেখও করা হয়।

এ কারণে মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডক ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বিরুদ্ধে অন্তত এক হাজার কোটি ডলারের মানহানির মামলা করেছেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ট্রাম্প দাবি করেছেন, চিঠিটি তিনি লেখেননি এবং বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে নির্দেশ দিয়েছেন, এপস্টেইন মামলার সব গ্র্যান্ড জুরি সাক্ষ্যের লিখিত প্রতিলিপি আদালতের মাধ্যমে প্রকাশের অনুরোধ করতে।

বিগত বছরগুলোতে এই দুজন একে অপরের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, কীভাবেই–বা তাঁদের সম্পর্কের উত্থান–পতন ঘটল, সেসব বিষয় তুলে ধরা হলো—

ট্রাম্পের পাঠানো জন্মদিনের চিঠিতে কী ছিল

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৩ সালে এপস্টেইনের ৫০তম জন্মদিনে তাঁকে একটি চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা চিঠি ও নোটের (ছোট বার্তা) সংগ্রহ উপহার দেওয়া হয়েছিল।

চিঠিগুলো তৈরি করেছিলেন গিলেন ম্যাক্সওয়েল। তিনি এপস্টেইনের সহযোগী ও প্রেমিকা ছিলেন এবং পরে তাঁর যৌন নিপীড়নের সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত হন। ২০২১ সালে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন ও ২০২২ সালে ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তিনি এখন কারাবন্দী।

চিঠিটি তৃতীয় পুরুষে টাইপ করা ছিল (অর্থাৎ চিঠিটিতে নিজেদের কথা বলার সময় ‘আমি’ নয়, ‘ডোনাল্ড’ বা ‘জেফরি’ নাম ব্যবহার করা হয়েছে—যেন নিজেরাই নিজেদের নিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কথা বলছেন)। এ ছাড়া মোটা মার্কার দিয়ে একজন নারীর স্তন আঁকা ছিল। এটি হাতে আঁকা বলে মনে হয়। চিঠিতে ‘ডোনাল্ড’ স্বাক্ষর করা ছিল। চিঠির শেষ লাইন ছিল, ‘শুভ জন্মদিন। আর প্রতিদিনই যেন একেকটা চমৎকার রহস্য হয়ে ওঠে।’ তবে আল–জাজিরা এ চিঠির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।

এ চিঠি প্রকাশের পর ট্রাম্প নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একটি ভুয়া চিঠি ছাপিয়েছে, যেটা নাকি এপস্টেইনকে লেখা। এগুলো আমার কথা নয়, আমি এভাবে কথা বলি না। এ ছাড়া আমি কোনো ছবি আঁকি না।’

ট্রাম্প লেখেন, ‘রুপার্ট মারডককে আমি বলেছিলাম, এটা একটা প্রতারণা। তবুও তিনি ছেপেছেন। এখন আমি তাঁকে ও তাঁর তৃতীয় শ্রেণির পত্রিকাকে আদালতে নিয়ে যাব। ধন্যবাদ!’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘এপস্টেইন নিয়ে এই ভাঁওতাবাজি ডেমোক্র্যাটদের ষড়যন্ত্র। এটা এখনই শেষ হওয়া উচিত। আমি অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে সব গ্র্যান্ড জুরির সাক্ষ্য আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকাশ করতে বলেছি।’

ট্রাম্পের বক্তব্যের পরপরই পাম বন্ডি এক্সে জানিয়েছেন, বিচার বিভাগ গত শুক্রবার আদালতে গ্র্যান্ড জুরি ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশের আবেদন করবে।

১৯৮০–এর দশক: ট্রাম্প-এপস্টেইনের বন্ধুত্ব শুরু

২০০২ সালে ট্রাম্প নিউইয়র্ক সাময়িকীকে বলেছিলেন, তিনি এপস্টেইনকে ’৮০–এর দশকের শেষ দিক থেকে চিনতেন। সে সময় ট্রাম্প একজন আবাসন ব্যবসায়ী ছিলেন।
ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি জেফকে ১৫ বছর ধরে চিনি। দারুণ লোক। তাঁর সঙ্গে থাকতে ভালো লাগে। আমার মতো তাঁরও সুন্দরী নারীর প্রতি দুর্বলতা আছে। সন্দেহ নেই, তাঁদের অনেকেই তরুণী। জেফরি তাঁর সামাজিক জীবন উপভোগ করেন।’

১৯৯০–এর দশক: পার্টি, উড়ান ও ঘনিষ্ঠতা

১৯৯২ সালে ট্রাম্প ফ্লোরিডায় তাঁর মার-এ-লাগো অবকাশযাপনকেন্দ্রে চিয়ার লিডারদের নিয়ে একটি পার্টির আয়োজন করেন। সেখানে এপস্টেইন উপস্থিত ছিলেন। এনবিসিকে অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। ওই পার্টির ভিডিওতে ট্রাম্প ও এপস্টেইনকে একসঙ্গে হাসতে দেখা যায়।

২০১৯ সালে এনবিসি অনলাইনে প্রকাশিত পার্টির ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ট্রাম্প এপস্টেইনের সঙ্গে হাসছেন। তাঁদের কথোপকথন গানের শব্দে শোনা যাচ্ছে না।

১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে ভিক্টোরিয়া সিক্রেটের ‘অ্যাঞ্জেলস’ পার্টিতেও দুজনকে একসঙ্গে দেখা যায়। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ট্রাম্প এপস্টেইনের প্রাইভেট জেটে মোট সাতবার ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে চারবার, ১৯৯৪ সালে একবার, ১৯৯৫ সালে একবার ও ১৯৯৭ সালে একবার। ফ্লাইটগুলো পাম বিচ ও নিউইয়র্কের মধ্যে ছিল এবং এর মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি স্টপেজ ছিল।

২০০০-এর দশক: একসঙ্গে পার্টি, ফাইলেও ট্রাম্পের নাম

২০০০ সালে মার-এ-লাগোতে একটি পার্টির ছবিতে ট্রাম্প, তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া এবং এপস্টেইন ও তাঁর প্রেমিকা গিলেনকে দেখা গেছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যৌন নিপীড়ক এপস্টেইনের সহযোগীদের শনাক্তকারী প্রায় ৯৫০ পৃষ্ঠার আদালতের নথি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। তাতে ট্রাম্পের নামও ছিল। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না।

এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগকারী নারীদের একজন ভার্জিনিয়া জিউফ্রে। তিনি আদালতে বলেন, ১৬ বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েল তাঁকে এপস্টেইনের শরীর মাসাজকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তখন তিনি মার-এ-লাগোতে কর্মরত ছিলেন। জিউফ্রে বলেন, এপস্টেইন ও ম্যাক্সওয়েল তাঁকে প্রিন্স অ্যান্ড্রুসহ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে প্ররোচিত করেছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিলে জিউফ্রে আত্মহত্যা করেন।

এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগকারী আরেক নারী জোহানা শোবার্গ। তিনি ২০০১ সালে ফ্লোরিডা থেকে আসা একটি ফ্লাইটের কথা স্মরণ করেন। সেখানে যাত্রীদের মধ্যে শুধু তিনি ও ভার্জিনিয়া জিউফ্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। ঝড়ের কারণে ফ্লাইটটি ট্রাম্পের ক্যাসিনোতে নামানো হয়।

২০০৩: জন্মদিনের চিঠি প্রকাশ

২০০৩ সালে এপস্টেইনকে লেখা ট্রাম্পের জন্মদিনের চিঠি নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প গত মঙ্গলবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, তিনি চিঠিটি লেখেননি এবং কোনো নারীর ছবিও আঁকেননি। তিনি আগেই ওই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন।

ট্রাম্প ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও এর প্রকাশক রুপার্ট মারডককে ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করেছিলেন যে সেটি একটি জাল চিঠি। তাঁরা এটি ছাপলে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

২০০৪: সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ

২০০৪ সালে পাম বিচে সমুদ্রতীরের একটি বন্ধ প্রাসাদ নিয়ে ট্রাম্প ও এপস্টেইনের মধ্যে মতবিরোধ হয়। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প বাড়িটি নিলামে জিতে নেন। এর পর থেকে তাঁদের সম্পর্কের তথ্য কম পাওয়া গেছে।

২০০৬: এপস্টেইনের বিরুদ্ধে মামলা শুরু

২০০৫ সালে ফ্লোরিডা পুলিশ ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীর ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগে এপস্টেইনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে। ওই কিশোরীর মা–বাবা অভিযোগটি করেছিলেন।

পাম বিচ পুলিশ এপস্টেইনের বিরুদ্ধে একজন নাবালিকার সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্কের একাধিক অভিযোগ আনে। ২০০৮ সালে এপস্টেইন দোষ স্বীকার করেন এবং দিনে কাজ করার সুযোগসহ ১৩ মাস রাতে কারাগারে ছিলেন।

২০১৯: এপস্টেইন আবারও গ্রেপ্তার, কারাগারে মৃত্যু

২০১৯ সালে ট্রাম্পের প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট মেয়াদে নিউইয়র্কের ফেডারেল প্রসিকিউটররা এপস্টেইনের বিরুদ্ধে নারী পাচারের অভিযোগ আনেন।

একই বছরের জুলাই মাসে ট্রাম্পের কাছে একজন সাংবাদিক এপস্টেইন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, পাম বিচের সবাই তাঁকে চিনত। আমিও তেমন চিনতাম। তিনি পাম বিচে একজন স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। অনেক দিন আগে তাঁর সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়েছিল। আমার মনে হয় না ১৫ বছর ধরে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি।’

২০১৯ সালের ১০ আগস্ট ম্যানহাটানের একটি কারাগারে এপস্টেইনের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প এ মামলা (এপস্টেইনের বিরুদ্ধে চলা যৌন অপরাধ ও মানব পাচার–সংক্রান্ত ফেডারেল মামলা, যা ২০১৯ সালে তাঁর গ্রেপ্তারের সময় চলমান ছিল) সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাই এবং আমি অবশ্যই এটা দাবি করছি।’

২০২৫: ‘এপস্টেইন তালিকা’ নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান পরিবর্তন

২০২৪ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি এপস্টেইনের মামলা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করবেন। পাম বন্ডিকে অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত করেন।

২০২৫ সালের ৭ জুলাই মার্কিন বিচার বিভাগ একটি স্মারকলিপি প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, সরকারি পর্যালোচনায় এপস্টেইনের নির্দিষ্ট ‘গোপন ক্লায়েন্ট তালিকা’ থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

স্মারকলিপিতে এপস্টেইনের আত্মহত্যার কথাও বলা হয়েছে। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ভিত্তিক অনেক ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক এ দাবিকে অস্বীকার করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এপস্টেইনকে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ, তাঁর কাছে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পর্কে সংবেদনশীল তথ্য ছিল।

৭ জুলাইয়ের স্মারকলিপি সম্পর্কে সাংবাদিকেরা ট্রাম্প ও বন্ডিকে প্রশ্ন করলে ট্রাম্প বলেন, এ সময়ে টেক্সাসের বন্যায় ১০৯ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখন এমন প্রশ্ন করে অমর্যাদা করবেন না।

ট্রাম্প সম্প্রতি এপস্টেইনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে তাঁর সমর্থকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লিখেছেন, ‘যারা এপস্টেইনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করে, তারা দুর্বল। তারা যেন আমাকে সমর্থন না করে।’

উল্লেখ্য, যৌন অপরাধে দণ্ডিত ও প্রভাবশালী মানুষদের নানা কৌশলে ফাঁদে ফেলার অভিযোগ থাকায় অনেকে এপস্টেইনকে ‘প্রতারক’ বলেও চিহ্নিত করেন।