
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (এফবিআই) পরিচালক ক্যাশ প্যাটেল ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) তাঁর অনুসারীদের দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এরপরই এক্স–এর চরম ডানপন্থী খ্রিষ্টান ও শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী অ্যাকাউন্টগুলো থেকে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ও মিম দিয়ে তার পোস্ট ভরিয়ে তোলা হয়।
একজন উগ্র ডানপন্থী ধর্মগুরু ক্যাশ প্যাটেলের পোস্টের নিচে মন্তব্য করেছেন, ‘নিজের দেশে ফিরে যাও এবং তোমাদের বালির দেবতার পূজা করো।’
আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘আমার দেশ থেকে বেরিয়ে যাও।’ এ ধরনের কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া লাখ লাখবার দেখা হয়েছে। তা–ও এগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত কম আক্রমণাত্মক মন্তব্য।
জাতিগত বিদ্বেষের একই ধরনের শিকার হয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি, সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বিবেক রামস্বামী এবং সিভিল রাইটসবিষয়ক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হারমিত ধিলোঁ। হোয়াইট হাউস, পররাষ্ট্র দপ্তর এবং টেক্সাস ও আরকানসাসের গভর্নরের দীপাবলি–সংক্রান্ত পোস্টেও একই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য দেখা গেছে।
কিছু ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রক্ষণশীল এসব ঘটনায় হতবাক। কারণ, ডানপন্থী রাজনীতিকদের একটি অংশ এখন তাঁদেরও নিশানা করছে। বিবেক রামস্বামী পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি বাদ দিন। আমরা আপনার গায়ের রং বা ধর্ম নিয়ে চিন্তা করি না, আপনার চরিত্রের গুরুত্ব দিই।’
অন্যদিকে, দীর্ঘকাল ধরে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বিদ্বেষ ছড়ানো ডানপন্থী ধারাভাষ্যকার ডিনেশ ডি’সুজা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘৪০ বছরের কর্মজীবনে আমি কখনো এমন ভাষা দেখিনি। ডানপন্থীরা আগে এমন কথা বলত না। তবে আমাদের পক্ষ থেকে কে এই ধরনের ঘৃণ্য অবমাননাকে বৈধতা দিল?’
এ ধরনের অবমাননাকর ভাষা নতুন না হলেও রাজনৈতিক ডানপন্থীদের দিক থেকে এ ধরনের কথাবার্তা ক্রমশ বেশি চোখে পড়ছে। একবার প্রান্তিক বলে বিবেচিত ব্যক্তিরা এখন প্রকাশ্যে আসছেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কঠোরভাবে প্রায় সব ধরনের অভিবাসনে কড়াকড়ি করার পর কিছু এমএজিএ (মাগা নামে পরিচিত) সমর্থক এখন প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টানদেরই থাকা উচিত।
অনলাইনে ভারতবিদ্বেষ এবং চরম ডানপন্থা নিয়ে গবেষণা করেন স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক সিদ্ধার্থ ভেঙ্কটারমাকৃষ্ণান। তিনি বলেন, আসলে আক্রমণ আসছে ঘরের ভেতর থেকেই।
ভারতীয় অভিবাসী এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন বা যাঁদের ভারতীয় বলে মনে করা হয়, তারা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান অভিবাসীবিরোধী আন্দোলনের নিশানায় পরিণত হয়েছেন। সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেটের গবেষকেরা গত এক বছরে ‘এক্স’-এ ভারতবিরোধী মনোভাবের ব্যাপক বৃদ্ধি নথিভুক্ত করেছেন। এ ধরনের প্রবণতা কমার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না।
কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক রাকিব নায়েক বলেন, তাঁর দল শুধু অক্টোবরেই ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ ও বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার করা প্রায় ২ হাজার ৭০০টি পোস্ট রেকর্ড করেছে। এর আংশিক কারণ হতে পারে, ইলন মাস্কের অধীন প্ল্যাটফর্মের নানা পরিবর্তন। আগে যেসব বর্ণবাদী কনটেন্ট মডারেটররা সরিয়ে দিতেন, এখন সেগুলো উৎসাহিত ও প্রসারিত হচ্ছে।
অনলাইনে ভারতীয় অভিবাসীবিরোধী বিদ্বেষের সবচেয়ে নিয়মিত নিশানা হলো এইচ–১বি ভিসা কর্মসূচি। এই ক্যাটাগরির ভিসার প্রধান সুবিধাভোগী হচ্ছেন ভারতীয় নাগরিকেরা। এই কর্মসূচির মাধ্যমে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন বিদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ ক্ষেত্রে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়।
ট্রাম্প সমর্থক শিবিরের মধ্যে এই ভিসা নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্পের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ স্টিফেন মিলারের মতো ভিসাবিরোধীরা ভারতের বিরুদ্ধে ‘অভিবাসন নীতিতে নানা প্রতারণা’ করার অভিযোগ তুলেছেন।
বর্তমানে, চরম ডানপন্থী অ্যাকাউন্টগুলো ভারতীয় অভিবাসীদের নিয়মিতভাবে প্রতারক হিসাবে তুলে ধরছে। তাদের অভিযোগ, এসব ভারতীয় তাদের যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ বেতনের চাকরি থেকে বঞ্চিত করছে। এজন্য তাঁরা এদের নির্বাসনের দাবি জানাচ্ছেন।
এসব ডানপন্থী মার্কিন নাগরিকের অভিযোগ, ভারতীয় অভিবাসীরা শুধু তাদের জাতি বা বর্ণের লোকদের ভালো ভালো চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে থাকে। এই ডানপন্থীরা ভারতীয়দের অপরিষ্কার বা দুর্গন্ধযুক্ত বলে গতানুগতিক ছাঁচে ফেলে দেন এবং হাতে করে খাওয়াসহ অন্যান্য আচরণকে সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা হিসেবে তুলে ধরেন।
সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোহিত চোপড়ার মতে, বর্ণবাদী ও অর্থনৈতিক ক্ষোভের এই পটভূমিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনদের সাফল্য এবং উচ্চমর্যাদা তাদের সহজ নিশানায় পরিণত করেছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় অভিবাসী ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনরা যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ উপার্জনকারী জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাঁরা মার্কিন সরকারের উচ্চ পদে আসীন হয়েছেন এবং শত শত কোটি ডলারের কোম্পানির সিইও হয়েছেন। গণমাধ্যম, বিনোদন, প্রযুক্তি, ব্যবসা, চিকিৎসা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের সর্বোচ্চ স্তরে তাদের উপস্থিতি রয়েছে।
চোপড়া সতর্ক করেছেন, ধনী ভারতীয় মার্কিনদের প্রতি দীর্ঘদিনের ক্ষোভ এখন পুরো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে বাস্তব জগতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।