রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের একটু সামনে রিকশা থেকে নামলাম গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে। মাথাভর্তি বৃষ্টি নিয়ে। সঙ্গে ছাতা নেই। একরকম ভিজতে ভিজতে রাস্তা পার হলাম। শহরের রিকশাগুলো তখন ঢেকে গেছে রঙিন পলিথিনে। বিশালাকার ছাতা নিয়ে হাত নাড়িয়ে ট্রাফিক সামলাচ্ছে পুলিশ।
মিরপুরগামী প্রজাপতি বাসে উঠে টের পেলাম আমার প্যান্ট অর্ধেক ভিজে শেষ। চুল থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। পুরো বাসে জুতায় করে আনা কাদামাটি আর বৃষ্টির পানি মিলে লালচে হয়ে আছে। বাসের এক যাত্রী দেখলাম নাক সিটকাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে। যতটুকু সম্ভব নিজেকে আগলে রাখছি এসবের থেকে। জানালার কাচভর্তি বৃষ্টির ফোঁটা। সেগুলো আলোতে চিকচিক করছে।
কচ্ছপের গতিতে বাস এগোচ্ছে গন্তব্যের দিকে। বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ছে থেমে থেমে। ১০ মিনিটের পথ আসাদগেট, ৫০ মিনিটেও পার হতে পারেননি ড্রাইভার। এক যাত্রী রেগেমেগে নেমেই গেলেন বাস থেকে। সম্ভবত হাঁটা দিয়েছিলেন। মিরপুর আরেকটু কাছে হলে আমিও হয়তো হাঁটাই দিতাম। বৃষ্টিতে হাঁটার অভিজ্ঞতা আছে বেশ ভালো, একবার গ্রিন রোড থেকে মিরপুর অব্দি পুরোটা এসেছিলাম হেঁটে। আজকাল ভিজতে ভয় হয়, জ্বরের ভয়। ভেজা প্যান্ট নিয়ে রীতিমতো বিরক্তি লাগছিল বসে থাকতে। কিন্তু কিছু করার নেই। বসে থাকা ছাড়া।
বৃষ্টি আবার বাড়ছে। বাসের কাচের জানালা দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। যেন হারমোনিয়ামের সুরে সুরে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তার মাঝখানে সবুজ গাছগুলো আরও সবুজ হয়ে পড়েছে। ভিজে ভিজে অনেকেই দৌড়ে এসে বাসে ঢুকছে। হাতের ছাতা থেকে টপটপ করে পানি পড়ে বাসের ভেতরে আরও ঘিনঘিনে হচ্ছে পরিবেশ। গা থেকে যেন উঠকো গন্ধ বের হচ্ছে। জানালা বন্ধ, বাতাস আসারও উপায় নেই। চুপচাপ সহ্য করে যাও বৃষ্টি দেখতে দেখতে।
আমাদের বাসের সাদা পাঞ্জাবি পরা হেল্পার তখনো দরজায় দাঁড়িয়ে ডেকে যাচ্ছেন মিরপুর, এয়ারপোর্ট, আব্দুল্লাহপুর...। আসাদগেট পার হয়ে বাস কতক্ষণ আটকে ছিল, সে হিসাব করিনি আর। শুধু দেখেছি বৃষ্টিতে রঙিন বাতি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা গাড়ির সারি।
আমার পাশের আগেরজন নেমে যাওয়ায় নতুন একজন বসেছেন। ফোনে কথা বলছে সম্ভবত ‘প্রেমিকার’ সঙ্গে, ‘আমি নেহাত ভালো মানুষ বলেই এত দিন আছি তোর সঙ্গে। আজকের পর থেকে আর কল দিবি না।’ তাঁদের মিনিট পাঁচেক কথোপকথনের মধ্যে আরও অনেক কথাই হয়েছে। ফোন কেটে চুপচাপ বাইরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলেন।
সঙ্গে ছাতা না থাকায় অনেককে দেখছিলাম দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছিল গাড়ির সারির সামনে দিয়ে। কেউ কেউ ছাতা হাতে সঙ্গের মানুষটাকে যতটুকু পারে আগলে নিয়ে। কেউ আবার একা একাই হেঁটে যাচ্ছে। আমার অপেক্ষা শুধু বাসের চাকা ঘোরার। কখন যাব বাসায়।
আরও মিনিট চল্লিশেক লেগেছিল টেকনিক্যাল মোড় পার হতে। সেখান থেকে আবার মোটামুটি ফাঁকাই ছিল রাস্তা। তবে টোলারবাগের এদিকে রাস্তায় পানি জমে একাকার। যাত্রীদের নির্ধারিত স্টপেজের আগেই নামতে বলছিলেন হেল্পার, ‘সামনে পুরো রাস্তায় পানি, নামলে এখানেই নামেন, না হয় পানির মধ্যেই নামতে হবে।’
স্বচ্ছ বৃষ্টির পানিও এই ঢাকার রাস্তায় ঘোলাটে হয়ে ভেসে যাচ্ছিল ম্যানহোলের দিকে। জ্যাম আর বৃষ্টি সঙ্গে নিয়ে মিরপুর ১০–এ আসতে আসতে প্রায় ১০টা বেজে গিয়েছিল। কিন্তু নামতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। রাস্তার পাশে তখন হাঁটুজল। প্যান্টটা আরও কিছুটা গুটিয়ে জ্যামে আটকে থাকা বাস থেকে নাক উঁচু করে ময়লা পানিতেই নেমে গেলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতেই। ভিজতে তখন আর খুব একটা মন্দ লাগছিল না। ভিজতে ভিজতে হেঁটে রওনা দিলাম বাসার দিকে। আমার লোকাল বাসের অস্বচ্ছ গ্লাসে ফোঁটা ফোঁটা রঙিন বৃষ্টি জমে আছে।