অ্যান্টার্কটিকা ঘুরে এল ঢাকার জামদানি

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন একবিংশ পর্ব

এই কক্ষে বসেই জাহাজ চালান ক্যাপটেন
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

জাহাজে এটিই শেষ লাঞ্চ। তাই দুপুরের খাবারের বিশাল আয়োজন। বাহারি সব খাবারদাবার, চেহারাও দারুণ আকর্ষণীয়; কিন্তু নামগুলো বড্ড কঠিন। মাতালের মতো টলতে টলতে ডাইনিং রুমে হাজির হলাম। উত্তাল সাগরের কারণে অনেকের অবস্থাই আমার মতো। মলিন মুখে বন্ধুদের বললাম, ‘খেতে আসিনি, হাজিরা দিতে এসেছি।’

টেবিলে কোনো গ্লাস নেই। থাকবে কী করে, ফ্লোরে পড়ে চুরমার হয়ে যাবে যে! শিকলে বাঁধা চেয়ার-টেবিল কাঁপছে। টেবিলে সাজিয়ে রাখা নানা পদের খাবার। একটি পাত্রে দেখি পায়েস! একেবারে আমাদের মতো করেই রান্না করা। বাড়তির মধ্যে ওপরে স্লাইস করে কাটা কয়েক টুকরা মাল্টা। সাদা রঙের ওপর কমলা রং, মানিয়েছে বেশ। কিন্তু এখানে পায়েস রাঁধল কে!

খাব না খাব না করেও তিন বাটি পায়েস খেয়ে ফেললাম। খেতে খেতেই শুনতে পেলাম ঘোষণা, খাবারের পর শুরু হবে ‘ব্রিজ’। শব্দটা শুনে প্রথমে মনে করেছি, সবাই জাহাজে তাস খেলতে বসবে। সমুদ্রভীতিতে বেতাল ছিলাম, খানিক পর তাল খুঁজে পেলাম। আদতে এই ব্রিজ মানে যে কক্ষে বসে ক্যাপটেন জাহাজ চালাচ্ছেন, সেখানে যাওয়ার সুযোগ। এই কক্ষ থেকেই ক্যাপটেনের নজরদারি চলে। এটা পাইলট হাউস বা হুইল হাউস নামেও পরিচিত। আবহাওয়া বোঝার জন্য ভালো জায়গা।

গাইডদের সঙ্গে লেখক

১০ জন করে ক্যাপ্টেনের রুমে ঢোকানো হচ্ছিল। একসময় আমিও সুযোগ পেলাম। আমাদের স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপটেন। সামনেটা কাচঘেরা। এই কাচ পানিরোধী। এত পরিষ্কার করে নিজ চোখেও বোধ হয় সমুদ্র দেখা যায় না, ব্রিজের এই গ্লাস দিয়ে যেমন দেখছি। ক্যাপটেন নিজে চেয়ারে বসে দেখাতে শুরু করলেন জাহাজ চালানোর পদ্ধতি, নেভিগেশন, গতি। আমার কেবল সামনে মাতঙ্গী সমুদ্রের শক্তি দেখতে ভালো লাগছে, ওই সব জটিল বিষয় মাথায় ঢুকছে না।

টাইটানিক চলচ্চিত্রে এসব কারিগরি বিষয় আগেই দেখেছি। একেবারেই টাইটানিকের মতোই এই জাহাজ। ক্যাপ্টেনের মুখের ওপর আমি আরেকটি মুখ দেখতে পাচ্ছি। তিনি এডওয়ার্ড জন স্মিথ, টাইটানিকের ক্যাপ্টেন। ঠিক এমনই তো দেখতে ছিলেন, যদিও তার সব ছবি সাদা-কালো। তখন বোধ হয় রঙিন ছবির ফিল্ম আবিষ্কৃত হয়নি। এই মনে হচ্ছে আমি বাস্তবে, আবার মনে হচ্ছে পরাবাস্তবে।

সামনের বৃহৎ প্রসারিত আয়না দিয়ে সমুদ্র দেখতে খুব আরাম। দেখছি, কীভাবে জাহাজের সামনের দিকে আছড়ে পড়ছে ঢেউ, আবার সরে সরে যাচ্ছে। সামনে আর কোনো কিছু নেই। এই কয় দিনে একটি জাহাজও চোখে পড়ল না। অন্য কোনো অভিযাত্রী দলও না। শুধু এই একখানা জলতরি। চলছে তো চলছেই। ক্যাপ্টেন বলছেন, এটি একটি বিরল পাওয়া আমাদের জন্য যে আমরা এই কক্ষে আসতে পেরেছি। অনেক অনেক বৃহৎ বাণিজ্যিক জাহাজ যাত্রীদের এই পর্যন্ত আসার অনুমতি দেয় না।

এক্সপেডিশন লিডার মারিওর সঙ্গে লেখক

টলতে টলতে ব্রিজ থেকে বের হতেই আরেক ঘোষণা। লেকচার হবে। একটি সিনেমা দিয়ে শেষ হবে লেকচার। না, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না, আমি যাবই না। আমি আজ ক্লাসের খারাপ ছাত্রদের একজন। আজ ক্লাসে যাব না। আমার কিছুক্ষণ শুয়ে থাকা জরুরি। না হলে পেটের তিন বাটি পায়েস বেরিয়ে আসবে। জাহাজের সব ফ্লোরে যত্রতত্র সাজানো আছে বমির উপদ্রবে সহায়ক কাগজের প্যাকেট। সিঁড়িতে সাজানো প্যাকেট থেকে একটি হাতেও নিলাম। যদি পথেই পেটের খানাপিনা বেরিয়ে আসে, তাহলে এই প্যাকেট সহায়ক হবে।

এই কয়েকটা দিন যতবার নানা কারণে কেবিন থেকে বেরিয়েছি, প্রতিবার ফিরে এসে দেখেছি, নতুন করে বিছানা গুছিয়ে রাখা। যা কিছু এদিক-ওদিক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখতাম, সব গোছানো পেয়েছি কক্ষে প্রবেশ করে। আমার আর নাস্তার মাথার কাছের টেবিলে প্রতিদিন কেউ দুটি করে চকলেট সাজিয়ে রেখেছে। টয়লেটের তোয়ালে পাল্টে দিয়েছে দিনে একাধিকবার। কক্ষে প্রবেশ করে মন চনমনে হতো। বুঝতে পারতাম, তিনি আর কেউ নন, জুবায়েদ। জুবায়েদ আমাদের ফ্লোরের দায়িত্বে থাকা হাউস কিপিং ক্রু। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। দুটি চকলেট টেবিলে রেখে দিয়েছে। একটি চকলেট মুখে দিলাম। আমার মনে হয়, টেবিলের ওপর চকলেট রেখে যাওয়ার ব্যাপারটি একেবারেই জুবায়েদের নিজস্ব খেয়াল। সেবা প্রদানে তার সৃজনশীলতা আমাকে বিমোহিত করেছে।

কাল আর্জেন্টিনায় ভিড়বে জাহাজ। এখনো কিছু গোছগাছ করিনি। ঘোষণা এল—সন্ধ্যায় ফেয়ারওয়েল ককটেল। সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। সাবধানে আমার ব্যাগের একেবারে তলা থেকে জামদানি শাড়িটি বের করলাম। আমার ভীষণ ইচ্ছা ছিল, ব্রাজিলে একদিন শাড়ি পরব। সেই উদ্দেশ্যে বাসা থেকে শাড়িটি ব্যাগে ভরে নিয়েছিলাম। ভ্রমণে কোনো দিন আগে শাড়ি নিইনি। ব্রাজিল ভ্রমণের সময় নানান ঝক্কির কারণে আর পরা হয়ে ওঠেনি। শাড়ির জমিন অফ হোয়াইট, মাঝেমধ্যে সূক্ষ্ম জরির কাজ। পুরো আঁচল সোনালি। সঙ্গে সাদা ব্লাউজ। গলায় সাদা মুক্তার মালা। কানে ঝিনুকের দুল। কপালে টিপ পরা হয়নি। টিপের পাতা ফেলে এসেছি ঢাকায়। শেষ পর্যন্ত বাংলার জামদানি শাড়ি এল কি না, অ্যান্টার্কটিকায়।

যতক্ষণ ধরে শাড়ি পরছি, ততক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল নাস্তা। বলল, দিল্লি ভ্রমণে গিয়ে একটি শাড়ি কিনেছে। নাস্তা কালো লম্বা জামা পরেছে, মাথায় পরেছে রুশ ক্রাউন। ঐতিহাসিকভাবে এটি বিবাহিত নারীদের হেড ড্রেস; কিন্তু অবিবাহিত নারীরাও পরছেন হরদম। আমি আমার ঢাকার জামদানির গুণগান করছি, সে করছে তার মাথার ক্রাউনের গান।

লাউঞ্জের প্রবেশমুখেই দাঁড়িয়ে সব গাইড। আমাদের অভিযানের ফটোগ্রাফার আমাকে দেখামাত্র বিস্ময়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, ‘ইস, আজই শুধু আমি কেবিন থেকে ক্যামেরা নিয়ে বের হইনি, আর আজই কিনা এমন চমক!’

লাউঞ্জে তিল ঠাঁই নেই। একেবারে সামনের সোফায় জায়গা আছে। সবাইকে ডিঙিয়ে সামনে গিয়ে বসলাম। রুমের মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের বয়নশিল্পের সুক্ষ্ম কারুকাজ দেখছেন। সবার সামনে মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন আমাদের এক্সপেডিশন লিডার মারিও। একসময় মারিও বলছেন, ‘এমন একজনকে পরিচয় করিয়ে দেব যিনি কি না, এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে। অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টা চালিয়ে তিনি আমাদের জাহাজে উঠেছেন। তার দেশ থেকে ভিসা হয়নি, ছিল আরও নানা সীমাবদ্ধতা। আমি এমন আত্মপ্রত্যয়ী অভিযাত্রী খুব কম দেখেছি। তিনি বাংলাদেশের মহুয়া রউফ।’

চারদিকে মুহুর্মুহু করতালি। আমি দুই হাত সামনে উঁচিয়ে ধরে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর চেষ্টা করছি।

আরও পড়ুন

১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?

২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা

৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’

৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি

৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি

৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী

৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি

৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়

৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম

১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই

১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল

১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্‌যাপিত হলো জন্মদিন

১৩. পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম

১৪. মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠাতে পারতেন তাঁরা, এতেই হতো যোগাযোগ

১৫. নদীপারের মেয়ে আমি কিন্তু বইঠা হাতে নিয়েছি আজই প্রথম

১৬. রূপপুরে কাজ করতে আসবে রাশিয়ার ওলগা, তাঁর সঙ্গে দেখা অ্যান্টার্কটিকায়

১৭. কবরের মতো বরফ খুঁড়ে সেখানেই থাকতে হয় রাতভর

১৮. একেকজন এগিয়ে যাচ্ছেন আর লাফিয়ে পড়ছেন সাগরের হিমশীতল পানিতে

১৯. এটি পৃথিবীর একমাত্র আগ্নেয়গিরি, যার কেন্দ্রে জাহাজ নিয়ে যাওয়া যায়

২০. ‘দ্রুত সবাই জাহাজের ভেতরে প্রবেশ করো, আবহাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক’