যুক্তরাজ্যে গিয়ে কী বলেছিলেন রাহুল? কেমব্রিজে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, এটা সবাই জানে ভারতীয় গণতন্ত্র হুমকির মুখে। গণতন্ত্রের বিকাশে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজন, যেমন সংসদ, স্বাধীন গণমাধ্যম, বিচার বিভাগ প্রতিটি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে চ্যাথাম হাউসের আলোচনায় রাহুল এ কথাও বলেছিলেন, ‘সমস্যাটা ভারতের। সমাধানও ভারতকেই করতে হবে। ভারতের মধ্য থেকেই সমাধানের সূত্র আসতে হবে। ভারতের গণতন্ত্র সারা বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়লে অন্য প্রান্তের গণতন্ত্রের ওপর তার প্রভাব হবে বিপুল। অতএব আপনাদের কাছেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।’
বিজেপি ও সরকারের অভিযোগ, রাহুল গান্ধী বিদেশে দাঁড়িয়ে দেশের সম্মানহানি করেছেন। দেশকে ছোট ও অযাচিত সব মন্তব্য করেছেন। আর এটা করেছেন, কারণ, নিজেকে তিনি দেশবিরোধী শক্তিগুলোর হাতিয়ার করে তুলেছেন। সরকার ও বিজেপি মনে করছে, এটা দেশের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য চক্রান্ত এবং তিনি তাঁর অংশীদার। অতএব রাহুলকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
রাহুল পাল্টা জানান, তাঁর নাম করে মন্ত্রীরা সংসদেই অভিযোগ করেছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে সেসবের জবাব দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার তাঁর আছে। তিনি সে জন্য লোকসভার স্পিকারের সঙ্গেও দেখা করে বলার অনুমতি চেয়েছেন। কিন্তু পাননি।
রাহুল সংসদে বিরোধীদের মাইক বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। শুধু বিরোধীদেরই নয়, সারা দেশ দেখল এবং প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বও দেখল, দুই সভাকক্ষের সব মাইক, এমনকি সংসদ টিভির সম্প্রচারও শব্দহীন করে দেওয়া হলো। সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁকে তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকার পক্ষই সংসদ অচল করে দিচ্ছে এবং তা করার মধ্য দিয়ে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের সেই স্বরূপই প্রকাশ পেল, রাহুল গান্ধীসহ অন্য বিরোধীরা যা বলে চলেছেন।
প্রশ্ন হলো, বিজেপি এই মান্যতা কেন দিচ্ছে এবং তার মধ্য দিয়ে তারা কোন রাজনীতি করতে চাইছে?
ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিজেপি খুব ভেবেচিন্তে দুটি বিষয়ের ওপর ধারাবাহিকভাবে জোর দিয়ে চলেছে। প্রথমত, উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিকাশ, যা করতে গিয়ে তারা সুকৌশলে মুসলমানবিরোধিতাকে বড় করে তুলে ধরেছে। সে কারণেই অযোধ্যায় রামমন্দির, তিন তালাকের অবলুপ্তি, জম্মু–কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ, এনআরসি–সিএএ, গোরক্ষায় জোর, লাভ জিহাদ, হিজাব–আজান–মাদ্রাসা বিতর্ক, রোমিও পুলিশ, বুলডোজার অভিযান ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদের বিকাশে সরকারের যাবতীয় বিরোধিতা ও সমালোচনাকে দেশবিরোধী প্রমাণে বাড়তি উদ্যোগী হয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে কাশ্মীরের পুলওয়ামা বিস্ফোরণ কেন্দ্র করে বিজেপি যে উগ্র জাতীয়তাবাদ আঁকড়ে ধরেছিল, দিন দিন তার ব্যাপ্তি ঘটিয়েছে। বিজেপির তৈরি করে দেওয়া জাতীয়তাবাদী সেই আখ্যানের ‘মাসকট’ হয়ে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর বিরোধিতার অর্থ হয়ে উঠেছে দেশের বিরোধিতা করা। ভারত ও মোদিকে করে তোলা হয়েছে সমার্থক।
১৯৭৬ সালে আসামের নেতা ও সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া যে মন্তব্য করে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন, সেই ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, অ্যান্ড ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’র হুবহু প্রতিফলন আজকের ভারতে বিজেপি ঘটিয়ে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির মাধ্যমে। ‘মোদি মানে ভারত, ভারত মানে মোদি’ এই আখ্যান দেশে ও বিদেশে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজেপির অভিধানে তাই মোদির সমালোচনার অর্থ দেশের সমালোচনা। রাহুলকে কোণঠাসা করার মধ্য দিয়ে বিজেপি এই নব আখ্যান প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট।
তবে এর ঝুঁকি প্রবল। বিপদও বিস্তর। বিজেপি মনে করছে, সেই বিপদ মোকাবিলার সময় তারা অনেক পাবে। এই মুহূর্তে প্রাথমিক লক্ষ্য আদানি প্রশ্ন থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আড়াল করা।
আদানি–কাণ্ড নিয়ে বিরোধীদের জবাব দেওয়ার মতো বিজেপি এখনো কিছুই করতে পারেনি। সংসদে নির্দিষ্টভাবে রাহুলসহ অন্য বিরোধী নেতারা মোদি–আদানি সম্পর্ক নিয়ে যত প্রশ্ন তুলেছেন, কোনোটা মনগড়া নয়। সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থনের দাবি জানিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে নতুনভাবে আদানি প্রসঙ্গে রাহুল যা বলেছেন, অবশ্যই তা শাসক দলের পক্ষে বিড়ম্বনার। যুগ্ম সংসদীয় দল (জেপিসি) গড়ে আদানি–কাণ্ডের তদন্তে বিরোধীদের দাবিও অন্যায্য নয়।
বোফর্স থেকে শুরু করে টু জি, কয়লা, কমনওয়েলথ গেমস, হর্ষদ মেহতা শেয়ার কেলেঙ্কারি, স্ট্যাম্প কেলেঙ্কারিতে জেপিসি গঠনের দাবিতে বিজেপিই ছিল সবার আগে। যে যুক্তি দেখিয়ে তারা বলে আসছে, অপরাধ না করে থাকলে তদন্তে আপত্তি কেন, সেই যুক্তি তাদের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। প্রধানমন্ত্রী অপরাধী না হলে তদন্তে আপত্তি কেন?
কিন্তু জেপিসি তো দূরের কথা, ইডি, সিবিআই বা সেবিকেও তদন্তের নির্দেশ সরকার আজ পর্যন্ত দেয়নি। আদানি–কাণ্ড নিয়ে একটি বিবৃতিও সরকার দেয়নি। রাহুলকে পাল্টা চাপে রাখার মধ্য দিয়ে সংসদ অচল রেখে বিজেপি বুঝিয়ে দিচ্ছে, আদানি–কাণ্ড থেকে মোদিকে আড়াল করা এই মুহূর্তে বেশি জরুরি। দল ও সরকারের এই আচরণ এ–ও বোঝাচ্ছে, রাহুলের বক্তব্যের মান্যতা দেওয়ার মতো আদানি–কাণ্ডে তাদের লুকানোরও অনেক কিছুই আছে। সেদিক থেকে চোখ ঘোরানোর সেরা উপায় রাহুলকে আক্রমণ।
রাহুলকে চাপে রাখতে বিজেপি লোকসভা থেকে তাঁকে বহিষ্কারের খাঁড়াটা ঝুলিয়ে রেখেছে। দুভাবে তারা সেই আক্রমণে উদ্যত। একটি হলো সভার অধিকার ভঙ্গ করার অভিযোগ এনে তা প্রমাণ করা। সেই উপায় আপাতত অধিকারভঙ্গ কমিটির বিবেচনাধীন। দ্বিতীয় উপায়, তাঁর সংসদ সদস্য পদ খারিজের জন্য বিশেষ কমিটি গঠনের চাপ সৃষ্টি করা। দুটি উদ্যোগই বিজেপি নিয়েছে এবং চাইলেই অতি দ্রুত তা কার্যকর করতে পারে। ভারতীয় সংসদীয় ইতিহাসে দুভাবেই সদস্য পদ খারিজের উদাহরণ আছে। অতএব উদ্যোগটি বেআইনি নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্ন হলো, বিজেপি শেষ পর্যন্ত ওই পথে হাঁটবে কি না।
প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক, কারণ, বিজেপি এখনো নিশ্চিত নয় রাহুলের সংসদ সদস্য পদ খারিজ করা হলে তা এক বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি ও ভবিষ্যতে দলের পক্ষে হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে কি না। দ্বিতীয়ত, দেশদ্রোহের অভিযোগে তাঁকে এই শাস্তি দেওয়া হলে তা মানুষ ঠিকভাবে নেবে কি না এবং বিদেশে মোদির ভারতের ভাবমূর্তি কোন আকার নেবে। তৃতীয়ত, দেশে ও বিদেশে গণতন্ত্রহীনতার যে অভিযোগ রাহুল তুলে ধরেছেন, তা আরও বেশি মান্যতা পেয়ে দলের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠবে কি না। চতুর্থত, সংসদ সদস্য পদ খারিজ কিংবা সাময়িকভাবে রাহুলকে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হলে সেই সিদ্ধান্ত বিরোধী জোট গঠনের অনুঘটক হয়ে উঠবে কি না, সে বিষয়েও বিজেপি নিশ্চিত হতে চায়। বিজেপি দেখছে, আদানি প্রশ্নে জেপিসি গঠনের দাবিতে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া সব বিরোধী দল কিন্তু কংগ্রেসের পাশে। আম আদমি পার্টি, তেলেঙ্গানার বিআরএস, সমাজবাদী পার্টি সবাই।
কংগ্রেসের কাছেও বিষয়টি উত্তেজক। দলের একটা বড় অংশ মনে করছে, রাহুলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে পুরো দল তেতে উঠবে। রাস্তায় নেমে আন্দোলনের আরও একটা বড় সুযোগ পাবে। দলকে নেতৃত্বদানের প্রশ্নে রাহুলের দ্বিধান্বিত ভাব কাটাতে তা যেমন সহায়ক হবে, তেমনই অন্যদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পাবে। গণতন্ত্রের বিপদ কী ভীষণ, তা অনুধাবন করে বিরোধীরা ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি ঠিক করে জোটবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সম্প্রতি চেন্নাইয়ে এই বার্তা দিয়ে এসেছেন যে সমভাবাপন্ন দলের জোট গঠনই এই সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। জোটের নেতৃত্ব কে দেবেন, সেটা বড় কথা নয়।
আদানি–কাণ্ড ও রাহুলের মন্তব্য নিয়ে ভারতের রাজনীতি যেভাবে আবর্তিত, তাতে বিজেপি ও কংগ্রেস দুই পক্ষই মনে করছে ‘অ্যাডভান্টেজ’ তাদের। জনমন কারা কতটা দোলাতে পারবে, সবার নজর সেদিকে।