
>বাংলা একাডেমির নজরুল স্মৃতিকক্ষটি প্রতিদিন দর্শকের জন্য খোলা থাকার কথা। অথচ সেটি তালাবদ্ধ থাকে সব সময়।
প্রাচীন বটগাছের কারণে বর্ধমান হাউসের এক পাশে থাকা ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষে’র সংস্কার করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। বটগাছের শিকড় ঢুকে গেছে ভবনের বেশ খানিকটা ভেতরে। ওই পাশটাতেই নজরুল স্মৃতিকক্ষের অবস্থান। কিছু ডালপালাও পৌঁছে গেছে দেয়ালে, জানালায়। তবে গাছের কোনো ক্ষতি না হয়, সেভাবে কক্ষটির সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কাজও শুরু হয়েছে।
স্মৃতিকক্ষটি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শকের জন্য খোলা থাকার কথা। অথচ সেটি তালাবদ্ধ থাকে সব সময়। সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্ধমান হাউসের সামনে অযত্নে পড়ে আছে নজরুলের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। অনুমতি নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা গেল ঘরটি ধুলাবালুতে একাকার। নষ্ট হওয়ার পথে বইপত্র। পলেস্তারা খসে পড়েছে দেয়াল থেকে। এক কোনায় ঝুলিয়ে রাখা বীণা হাতে নজরুলের ওপর আঁকা একটি চিত্রকর্ম প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।
নজরুল স্মৃতিকক্ষটি নতুন করে খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই একুশে গ্রন্থমেলার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। এরপরই আমি কক্ষটি সংস্কার করে দর্শনার্থী এবং গবেষকদের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। ভবনটি খুব পুরোনো, বয়সের ভারে কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। বটগাছের শিকড় ভেতরে ঢুকে গেছে। তাই ভবনের কাঠামোও দুর্বল হয়ে গেছে। খুব সাবধানে, ধীরেসুস্থে কাজ করতে হচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, সম্পূর্ণ নতুন অন্দরসজ্জায় (ইন্টেরিয়র) কক্ষটি সাজানো হবে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় যেখানে বইপত্র ছাড়াও নানা রকমের ডিজিটাল পরিবেশনা থাকবে। গান শোনার ব্যবস্থা থাকবে।
১৯২৬ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে নজরুল অনেকবার ঢাকায় এসেছেন। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে আছে নজরুলের অনেক দিনের স্মৃতি। মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসে তিনি প্রায় আড়াই সপ্তাহ ছিলেন। তখন প্রথম দিকে আবুল হোসেনের বাসায় উঠলেও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কবির বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের বাসা বর্ধমান হাউসে (১৯৫৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমি) ওঠেন। কয়েক মাস পর হঠাৎ বন্ধুদের সঙ্গে আবার আসেন। তখন তিনি হাউস বাউন্ডারির মধ্যে অবস্থিত বড় একটি পুকুরে নিয়মিত সাঁতার কাটতেন। অবসর সময় পুকুরঘাটে বসে আড্ডা দিতেন।
বর্ধমান হাউসে কবি কয়েকটি কালজয়ী রচনা লেখেন। বর্ধমান হাউসে কবি নজরুলের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে। কাজী মোতাহার হোসেন দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলতুন্নেসা নামের এক নারীর সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। ফজিলতুন্নেসা ছিলেন প্রথম মুসলিম ছাত্রী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেনের দূরসম্পর্কের বোন। সেই সুবাদে তাঁর বাসায় ফজিলতুন্নেসার আসা-যাওয়া ছিল।
বর্ধমান হাউসে কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ১৯৭৮ সালের ২৯ আগস্ট কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ব্যতিক্রমী ও ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওই দিন বর্ধমান হাউসের দোতলায় পশ্চিম দিকে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষে’র উদ্বোধনী হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন। সেদিন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে কাজী মোতাহার হোসেন দর্শকদের মন্তব্যের খাতায় লিখেছিলেন, ‘আজ ২৯/৮/৭৮ তারিখে নজরুল স্মৃতিকক্ষ উদ্বোধন করা হলো। এটা আমার পক্ষে অতিশয় সুখের দিন; অবশ্য সে আমার নিজের গুণে নয়, নজরুল যে আমার সমসাময়িক কালের বন্ধু ছিলেন।’ আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের নজরুল-বিষয়ক একক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল উদ্বোধনী দিনে।
ঘটা করে উদ্বোধন হলেও ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’টি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারেনি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। একাডেমির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এর আগে কক্ষটি দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত হতো। বসতেন একাডেমির কর্মকর্তারা। একসময় এটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।