Thank you for trying Sticky AMP!!

পলিথিনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা নিয়ে ভাবনা

মিরপুরের কালশী রোডে ফলের ভাসমান দোকানগুলোতে পলিথিনের ব্যাগ দেদার ব্যবহৃত হয়। ছবি: প্রথম আলো

উৎপাদন, ব্যবহার বিপণন ও বাজারতকরণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পলিথিন এমন একটি দ্রব্য, যেটি ছাড়া বর্তমান বিশ্ব কল্পনা করা যায় না। পৃথিবীতে সব উপাদানের চাহিদার ঊর্ধ্বে রয়েছে পলিথিন। এমন একটি সময় ছিল, যখন বাজারে গেলে মানুষ চটের ব্যাগ নিয়ে যেতেন। কিন্তু এটি অনেক আগের কথা।

আশির দশকে বাজারে প্রথম পলিথিন আসে। তারপর থেকে বাজারে যেকোনো ধরনের দোকানে যাওয়া হোক না কেন, যেকোনো দ্রব্য কিনলে ফ্রিতে আপনাকে পলিথিনের ব্যাগ দেবেই। বাজারে যেকোনো দোকানে চাইলেই বিনা পয়সায় পলিথিনের ব্যাগ পাওয়া যায়।

এখন প্রশ্ন হলো পলিথিন কী? পলিথিন হচ্ছে ইথিলিনের পলিমার। এটি অত্যন্ত পরিচিত প্লাস্টিক। উচ্চ চাপে (১০০০ থেকে ১২০০ এটিএম) ও তাপমাত্রা ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সামান্য অক্সিজেনের উপস্থিতিতে তরলীভূত হয়ে অসংখ্য ইথিলিনের অণু (৬০০ থেকে ১০০০) মতান্তরে (৪০০ থেকে ২০০০) পলিমারাইজেশন প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়ে পলিথিন গঠন করে। পলিথিন সাদা ও অস্বচ্ছ ও নমনীয় কিন্তু শক্ত প্লাস্টিক। অ্যাসিড, ক্ষার এবং অন্যান্য দ্রাবক দ্বারা আক্রান্ত হয় না। উত্তম তড়িৎ-অন্তরক।

বর্তমান বাজারে বিভিন্ন গ্রেডের পলিথিন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রেড হলো HDPE (high-density Polyethylene), LLDPE (Linear Low-density Polyethylene) এবং LDPE (Low-density Polyethylene)।

পলিথিন উন্নত বিশ্বে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও এটি পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকারক। পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক পরে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু অনেক পরে হলেও এ দেশে পলিথিনের প্রসার খুব দ্রুত ঘটে। নামমাত্র মূল্যে হাজারো পলিথিনের ব্যাগ পাওয়া যাওয়ায় এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৩ সালে সারা দেশে গড়ে ৪৫ লাখ পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার হতো। ২০০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ লাখে। এদিকে ব্যবসায়ীদের হিসাবমতে, বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে।

বর্তমান সময়ে পলিথিনের গঠনে কিছু ভিন্নতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অতীতে ব্যবহৃত হওয়া পলিথিনের সঙ্গে বর্তমানে ব্যবহৃত পলিথিনের পার্থক্য হচ্ছে অতীতে ব্যবহৃত পলিথিনের শপিং ব্যাগে হাতল ব্যবহৃত হলেও বর্তমানের পলিথিন ব্যাগগুলো ঠোঙা আকৃতির। এ ছাড়া টিস্যু কাপড়ের মতো দেখতে বিভিন্ন রঙের ব্যাগ পাওয়া যায়। তবে এগুলো দেখতে টিস্যু ব্যাগের মতো হলেও আগুনে দিলে গলে যায়। অর্থাৎ এসব ব্যাগ পলিথিনের তৈরি বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

কারওয়ান বাজারে পলিথিনের পাইকারি দোকানে পলিথিন ব্যাগ দেখাচ্ছেন বিক্রেতা। ছবি: প্রথম আলো

১৯৮২ সালের পর থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার শুরু হয় বাংলাদেশে। থার্মোপ্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ দিয়ে প্রস্তুত করা হয় পলিব্যাগ। খুব কম পুঁজি বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ায় এ খাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন অসংখ্য ব্যবসায়ী। বর্তমান বাজারে প্রায় সব পণ্যদ্রব্যে মোড়ক এবং শপিং ব্যাগ হিসেবে ব্যবহৃত হয় পলিথিন। যেমন: বিস্কুট, চকলেট এবং বিভিন্ন প্যাকেটজাত দ্রব্যের মোড়ক হিসেবে পলিথিন ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ এটি ছাড়া প্যাকেটজাত দ্রব্য দেশে কল্পনাই করা যায় না। বাজারে যেকোনো শাকসবজি, মাছ-মাংস অথবা খুচরা চাল-ডাল এবং আটা-ময়দা কিনলে আপনাকে শপিং ব্যাগ হিসেবে পলিথিনের ব্যাগটি নিতে হবে। আর এই বিপুল চাহিদার পলিথিন জোগান দিচ্ছে দেশে অবস্থিত পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানাগুলো।

বাংলাদেশ পলিপ্রোপাইল প্লাস্টিক রোল অ্যান্ড প্যাকেজিং অ্যাসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে এক হাজারের বেশি পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৭০০টি কারখানা রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকার বেশির ভাগই পুরান ঢাকার কোতোয়ালি, চকবাজার, বেগমগঞ্জে। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, কামরাঙ্গীরচর ও টঙ্গীতে রয়েছে পলিথিনের কারখানা।

পোশাকশিল্পের একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে পলিথিন। পোশাকের প্যাকেজিং প্রক্রিয়া পুরোটা জুড়েই রয়েছে পলিথিনের ব্যবহার। ভবিষ্যতে পোশাকশিল্পের সঙ্গে সঙ্গে পলিথিনের ব্যবহার বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। এদিকে কৃষিক্ষেত্রেও পলিথিনের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন ধরনের চারা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগে। শীতকালে বোরো ধানের চারা ও বীজতলা কুয়াশার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে দেখা যায়।

মিরপুরের কালশী রোডে পলিথিনের ব্যাগে ফল ভরে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। ছবি: প্রথম আলো

এদিকে এক নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে বাউকুলে পলিথিনের ব্যবহার কুল চাষে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। এ পদ্ধতিতে ছয় থেকে সাতটি কুলের ওজন এক কেজি। দাম ও পাওয়া যাচ্ছে ভালো। সাধারণত উৎপাদিত বাউকুল পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর পলিথিন পদ্ধতিতে উৎপাদিত কুল প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। কুলে পলিথিন ব্যবহার করার ফলে কীটনাশক দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। ফলে বিষমুক্ত এই কুল সাধারণ বাউকুলের থেকে মিষ্টি ও নরম। আবার পলিথিনের মালচিং পেপার ব্যবহার করে টমেটো চাষে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে টমেটো গাছের বীজতলা পলিথিনের মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় এবং শুধু চারার অংশটুকু ছিদ্র করে দেওয়া হয়, যার কারণে চারাটি বড় হতে কোনো বাধাপ্রাপ্ত হয় না। এতে করে অতিবৃষ্টি ও রোদ থেকে রক্ষা পায় টমেটো গাছ। এর দরুন ফলন ভালো হয় এবং বারবার কীটনাশক প্রয়োগ ও আগাছা পরিষ্কারের প্রয়োজন পড়ে না। টমেটোগাছের গোড়ায় পানি জমলে ফলন অনেক কমে যায় এবং চারাটি মারা যেতে পারে। পলিথিনের মালচিং পেপার ব্যবহার করার কারণে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি হয় বলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে জানা যায়। পলিথিনের কৃষিক্ষেত্রে চাহিদা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।

ওষুধশিল্পে পলিথিনের ব্যবহার ও চাহিদা দুটোই প্রসারিত হচ্ছে। ওষুধের প্যাকেট প্রক্রিয়াকরণে পলিথিনের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন: স্যালাইন, গ্লুকোজ, সিরিঞ্জ এবং তরলজাত ওষুধ প্যাকেজিং প্রক্রিয়ায় পলিথিনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

পরিত্যক্ত পলিথিন থেকে জ্বালানি উৎপাদন সম্ভব। এক গবেষণায় দেখা যায়, পলিথিনের ওজনের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জ্বালানি উৎপাদন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক দু-একটি প্ল্যান্ট চালু হয়েছে বলে জানা যায়। তবে আমাদের দেশে পলিথিনের বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির ঘটনা নতুনই। পলিথিন পরিবেশের জন্য হুমকি হলেও এটি ব্যবহার বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ বাজারে এলেও জনসাধারণের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ, পলিথিনের মতো পাটের তৈরি ব্যাগ সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য নয়। তরলজাত দ্রব্য পলিথিন ব্যাগ ব্যতীত বহন কারা সম্ভব হয় না। সর্বোপরি পলিথিন বর্তমান সময়ে এক অপরিহার্য উপাদান। বর্তমানে বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। পরিশেষে বলা যায়, পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এটি ব্যবহার করছেন। এর থেকে রক্ষার উপায় ভাবা দরকার। আর আমরা এর ব্যবহার করব কি না, তাও ভেবে দেখা দরকার।

লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ