
বাংলাদেশে মহিষের মাংস স্বনামে পাওয়া কঠিন, আর উটের মাংস পাওয়া যায় না দুষ্প্রাপ্যতার কারণে। সৌদি আরব উটের দেশ। তাই ধারণা করেছিলাম, এখানে দিনে অন্তত দুই বেলা উটের মাংসের টুকরো খাবার প্লেটে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পুরো যাত্রায় দুই বারের বেশি জোটেনি। কারণ, দামটা বড্ড বেশি। তবে স্বাদে দারুণ।
সৌদি আরবে প্রায় সব দেশের খাবারই পাওয়া যায়। ভাত, মাছ, মাংস, সবজি, ডাল প্রভৃতি দেশি খাবার খেয়েছি। সৌদি খাবারও সস্তাই মনে হয়েছে। কয়েকটি খাবারের কথা বলছি:
খবুজ: একধরনের রুটি। দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের তন্দুর রুটির মতোই। মাত্র এক রিয়ালে (এক রিয়ালে প্রায় ২১ টাকা) ছয়টি খবুজ পাওয়া যায়। ডাল অথবা মুরগির মাংসের সঙ্গে খেতে দারুণ লাগে।
তামিয়া: এটি মিক্সড স্যান্ডউইচের মতো। অর্ধেক খবুজের ভেতর ডিমের ফালি, শসা, টমেটো, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পেঁয়াজু, সস ও মেয়োনেজ দিয়ে পরিবেশন করা হয়। তামিয়ার মধ্যে রকমফের আছে। যেমন: ডিম তামিয়া, তামিয়া মোশাক্কেল। দুই রিয়ালের তামিয়া মোশাক্কেল সকাল-বিকেলের নাশতা হিসেবে ভালো। হজ মিশনের কাছে মিসফালাহ কেদুয়া গ্রিন পার্কের কাছে একটি ছোট দোকান চালান কেরালার কবির। আমাকে দেখলে বেশ খাতির করেন। ১০ বছর ধরে তাঁর দোকানে তামিয়া খাই।
আল-ফাহাম: বড় থালায় বিশেষ ধরনের রান্না করা লাল-ভাতের মাঝখানে কয়লায় পোড়ানো মুরগি। সৌদিরা বিশাল থালার চারপাশ ঘিরে মজা করে পাঁচ-ছয়টি আল-ফাহাম খায়।
তমিজ: মিসফালাহ গ্রিন পার্কের কাছে একটি দোকানে আফগানিস্তানের লোকজনের চালানো একটি দোকান। এখানে পাবেন ‘ফুল’ তমিজ। একধরনের রুটি। আমাদের দেশের কয়েকটা তন্দুর রুটির সমান। একটার দাম তিন রিয়াল। সঙ্গে একবাটি ঘন মসুর ডাল আর একবাটি ‘ফুল’ মাত্র দুই রিয়ালে। এই ফুল হচ্ছে একধরনের সিমের বিচি (বিন) পিষে বানানো তরকারি। তমিজ খেতে হয় গরম গরম। আরও আছে তমিজ বিস্কুট, গেলাবা। দুজন মিলেও একটা তমিজ শেষ করা যায় না।
খেপসা বা খেবসা: খুব জনপ্রিয় খাবার। কারও বাসায় দাওয়াত থাকলে খেবসা থাকবেই। মূলত ইয়েমেনি খাবার। তবে আরব দেশগুলোতে সবাই এটা পছন্দ করে। খেবসা হচ্ছে বাসমতি চাল ও বিশেষভাবে তৈরি মাংসের মিশ্রণ। মুরগি, গরু বা ভেড়ার মাংস, এমনকি মাছ দিয়েও খেবসা তৈরি করা হয়। হালকা মসলায় কম তেলে রান্না করা বিরিয়ানির মতো। আমাদের সঙ্গী এক ভদ্রলোক জানালেন, খেপসার সঙ্গে মুরগি থাকলে বলা হয় খেপসা দুজাজ আর ভেড়া/দুম্বা থাকলে খেপসা লাহাম।
মেন্দি: ইয়েমেন ও সৌদি আরবের একটা ঐতিহ্যবাহী খাবার। লোকে আয়েশ করে খায়। মাটির নিচে বিশেষভাবে রান্না করা ভাত ও মাংসের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় মেন্দি। মাটিতে গর্ত করা চুলায় কয়লার আগুনের তাপে ভাত ও মাংস সেদ্ধ করা হয়। ভাতের মধ্যে কিছু দারুচিনি, এলাচি, কিশমিশ দেওয়া হলেও মাংসে কোনো মসলাই দেওয়া হয় না। ছাগল বা দুম্বা জবাই করার পর রক্ত পরিষ্কার করে কিছু লবণ ও তেল মাখিয়ে আস্ত শরীরটাই চুলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। চুলার নিচে থাকে ভাতের পাতিল, ওপরে ঝুলন্ত ছাগল। প্রচণ্ড তাপে ছাগলের শরীরের চর্বির খণ্ড নিচে ভাতের ওপর পড়তে থাকে। আর এতে নাকি স্বাদও বৃদ্ধি পায়। মক্কার আজিজিয়া এলাকায় ‘মাতাম আর রাইদানে’ ৪৫ রিয়ালে অর্ধেক (হাফ) মেন্দি খেলাম অসাধারণ।
গাওয়া: গরম পানিতে বিভিন্ন ধরনের মসলা দিয়ে তৈরি বহুল প্রচলিত একটি পানীয়। কাপে করে চায়ের মতো পান করতে হয় গরম গরম। গাওয়া খেলে নাকি শরীর চাঙা হয়, কর্মস্পৃহা বাড়ে, খুসখুসে কাশি সেরে যায়। কোনো চিনি দেওয়া নেই। অনেকে খেজুর দিয়ে খান।
সৌদিরা বেশ চা, কফি পান করে। বেশি চিনি দেওয়া দুধ ছাড়া চা। অল্প চা পাতার সঙ্গে এলাচি ও পুদিনা পাতা মিশিয়ে তৈরি সুগন্ধি চা। আরবিতে বলে শাহি। বাসাবাড়িতে টেবিলের চেয়ে নিচে বসে কার্পেটের ওপর দস্তরখানা (ছুফরা) বিছিয়ে পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খায় সৌদিরা। কোনো কোনো রেস্তোরাঁর একপাশে নিচে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।