
গাছপালায় ঘেরা কাঁকর মেশানো লাল মাটির খোলা চত্বরে বসানো হয়েছে কয়েকটি তাঁবু। চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে পড়েছেন লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘ শান্তি মিশনের ব্যানমেড-৯-এর চিকি ৎ সকেরা। বাংলাদেশের সেনা চিকি ৎ সকদের এটি নবম ব্যাচ।
আশপাশের লোকালয়গুলোর মানুষ এত দিনে জেনে গেছে শুক্রবার, ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিক। বাংলাদেশ ক্যাম্পে গেলে বিনা খরচে মিলবে ওষুধ, পরামর্শ, এমনকি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে তা-ও। বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষ, শিশুরা এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে লাইন ধরে। শিশুর সংখ্যাই বেশি। কেউ এসেছে পেটব্যথা নিয়ে, কারও চোখ হলুদ, নাকে সর্দি, গায়ে জ্বর, মাথাব্যথা। কারও হাত কেটেছে, কেউ বা খেতে কাজ করতে গিয়ে নিজের হাতের হাতিয়ারেই কেটেছে নিজের পা। বয়স্ক নারী ও পুরুষের অনেকে এসেছেন চোখের সমস্যা নিয়ে, কারও বুকে ব্যথা, কেউ বা ভুগছেন শ্বাসকষ্টে।
সবার চোখে-মুখে কেমন এক ক্লিষ্টতা। যে প্রকৃতির সন্তান এরা, সেই মা-প্রকৃতিই যেন কাবু করে ফেলেছে এদের।
স্কুলে গিয়েছে কি যায়নি, তাতে কিছু এসে যায় না, এরা প্রায় সবাই নিজস্ব উচ্চারণে ইংরেজি বলে। মন দিয়ে শুনলে তার অর্থ উদ্ধারও করা যায়। সবার মুখে কেবলই প্রশংসা: বাংলাদেশ গুড, বাংলা পিপল গুড, বাংলা ডক্টর গুড। কিছু দূরে একটি সরকারি হাসপাতাল আছে, সেখানে না গিয়ে এখানে এসেছেন কেন? এ কথা জিজ্ঞেস করলে এক নারী বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে পয়সা লাগে। আমাদের পয়সা নেই। আর ওরা যে ওষুধ দেয়, তাতে কোনো কাজ হয় না। এই ক্যাম্পে এলে পয়সা দিতে হয় না। বাংলাদেশের ট্যাবলেট একটা খেলেই অনেক কাজ হয়।’
যে তাঁবুটির নিচে একটি টেবিলে ওষুধপত্র রাখা হয়েছে, সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, সব ওষুধই বাংলাদেশের তৈরি। চিকি ৎ সকেরা বললেন, আমাদের দেশের ওষুধের মান সত্যিই বেশ ভালো। এখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, ৩৬ শতাংশ মানুষ ভোগে এই ব্যাধিতে। এমনকি শান্তি মিশনে আসা সামরিক ব্যক্তিদেরও ২৬ শতাংশ এই জ্বরে পড়েন।
ব্যানমেড-৯-এর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল বাসীদুল ইসলাম বললেন, ‘ম্যালেরিয়ার চিকি ৎ সায় বাংলাদেশের চিকি ৎ সকদের সাফল্য এ দেশে ভীষণভাবে প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের চিকি ৎ সকেরা এমনকি সেরেব্রাল ম্যালেরিয়ার রোগীকেও সারিয়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ার ওষুধ উ ৎ পাদনেও যুগান্তকারী সাফল্য এসেছে; ম্যালেরিয়ার সেরা ওষুধ এখন তৈরি করে বাংলাদেশ।’
মিশন অ্যাসেসমেন্ট টিমের নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গাজী ফিরোজ রহমান প্রসঙ্গক্রমে বললেন, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনীর চিকি ৎ সকদের দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার একটা প্রভাব ম্যালেরিয়া চিকি ৎ সায় এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বলে তাঁর মনে হয়।
জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সঙ্গে চিকি ৎ সক কন্টিনজেন্ট থাকে মূলত শান্তিরক্ষীদের চিকি ৎ সার জন্য। এখানে ২০ শয্যার একটি দ্বিতীয় পর্যায়ের হাসপাতাল পরিচালনা করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকি ৎ সকেরা। কিন্তু তাঁরা কেবল এ কাজেই সীমাবদ্ধ রাখেননি তাঁদের ভূমিকা। আদতে এখানে মাত্র ১৫ শতাংশ চিকি ৎ সা নেন সামরিক শান্তিরক্ষীরা, ৮৫ শতাংশই স্থানীয় বেসামরিক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের চিকি ৎ সকদের এ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তাঁরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চিকি ৎ সাসেবা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।
কর্নেল বাসীদুল ইসলাম বলছিলেন, এখনকার ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিকের কথা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূর পর্যন্ত। এমনকি এক শ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পাশের দেশ গিনি থেকেও লোকজন আসে এখানে চিকি ৎ সা নিতে।
আমাদের সফরসঙ্গী বাংলাদেশ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক শাহীনুল ইসলাম সাধারণ বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে চিকি ৎ সাসেবা দেওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, হানাহানি-রক্তপাতের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি উন্নয়ন ও মানবিক উদ্যোগও জাতিসংঘ শান্তি মিশনের কাজের অংশ। লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘ শান্তি মিশন যুদ্ধ করছে না; বরং শান্তি যেন টেকসই হতে পারে, সেই লক্ষ্যে কিছু উন্নয়নমূলক ও মানবিক সেবামূলক কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করছে।
লাইবেরিয়ার বং নামের কাউন্টির যে জায়গাটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকি ৎ সক দলের ক্যাম্প, সেই ক্যারি কমপ্লেক্সের আশপাশের তো বটেই, দূরদূরান্তের মানুষও বাংলাদেশের নাম জানে। কারণ, চিকি ৎ সা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সেনা চিকি ৎ সকদের যোগাযোগ ঘটে। ২০০৪ সাল থেকে পরবর্তী নয় বছরে মোট ৬১ হাজারের বেশি মানুষকে চিকি ৎ সাসেবা দিয়েছেন বাংলাদেশের সেনা চিকি ৎ সকেরা। এদের সিংহভাগই স্থানীয় সাধারণ মানুষ।
ব্যানমেড-৯-এর দাপ্তরিক নোটিশ বোর্ডে ঝুলছে এক বালিকার হাতে লেখা চিঠি। যক্ষ্মা থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য পাওয়ার পর সুন্দর গোটা গোটা হস্তাক্ষরে সে লিখেছে:
‘ডিয়ার বাংলাদেশি ডক্টরস,
আই গ্রিট ইউ অল ইন দ্য নেম অব অলমাইটি গড। আই টেক দিস টাইম টু গিভ মাই থ্যাংকস অ্যান্ড অ্যাপ্রিসিয়েশন টু ইউ অল ফর দ্য জব অয়েল ডান বাই হেল্পিং মি উইথ মাই টিবি মেডিকেশন।...থ্যাংক টু ইউএন ফর সেন্ডিং ইউ পিপল ফ্রম বাংলাদেশ হিয়ার।
কাইন্ডলি ইয়োর্স
রোজেলিন।