
যমুনা রেলসেতু বাংলাদেশের প্রশস্ত যমুনা নদীর ওপর অবস্থিত একটি রেলসেতু। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেলসেতু। যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নির্মিত এই সেতু ডুয়েল গেজ, ডাবল ট্র্যাক সেতু। যমুনা নদীর মতো গতিশীল নদীতে এমন সেতু নির্মাণের নানা চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা নিয়ে জানাচ্ছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর মনজুর।
নতুন সেতুর গল্প
শক্তিশালী ও প্রবহমান যমুনা নদীর ওপর বর্তমান সড়কসেতুর পাশে নতুন রেলসেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই রেলসেতুতে আসা–যাওয়ার দুটি লাইন (ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাক) রয়েছে। ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন সেতুর একটি লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। মূল সেতু পার হতে ট্রেনে লাগবে দুই-তিন মিনিট। সেতুর দুই পাড়ের স্টেশন সয়দাবাদ ও ইব্রাহিমাবাদের মধ্যে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এই অংশ পার হতে ৭ মিনিটের বেশি লাগছে না। আগে যমুনা সড়কসেতুর সঙ্গের রেলসেতু পার হতে ট্রেনের সময় লাগত ২০–২৫ মিনিট। নতুন সেতু দিয়ে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি যাতায়াতের সময়ও কমছে। নতুন সেতু চালুর ফলে পুরোনো যমুনা সড়কসেতুর রেলপথ দিয়ে আর ট্রেন চলাচল করছে না।
গতিশীল নদীতে সেতু নির্মাণ চ্যালেঞ্জিং
গতিশীল নদীতে যেকোনো সেতু নির্মাণ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। নদীর প্রবাহের তীব্রতা, পলি বহনের ক্ষমতা এবং ভাঙনপ্রবণতা সেতুর ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। মো. মুজিবুর রহমান বলেন, যেকোনো নদীর ওপরে সেতু–কাঠামো নির্মাণের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরে প্রভাব পড়ে। সেতুর কারণে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ, গতিপ্রবাহে প্রভাব তৈরি হয়। নদী যেহেতু একটি জীবন্ত সত্তা, এখানে শুধু পানি প্রবাহিত হয় না, নদীর জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেতু নির্মাণের কারণে নদীর গতিপ্রবাহ পরিবর্তন হয়। যমুনা নদীর স্রোত অনেক গতিশীল ও শক্তিশালী। আমাদের দেশের প্রায় সব নদী উৎপত্তিস্থল থেকে অনেক দূরে ও সমুদ্রের কাছাকাছি বলে আচরণের দিক থেকে অনেক শক্তিশালী। নদীর ওপরে সেতু নির্মাণে নদীর তথ্য নিয়ে সমীক্ষা করতে অনেক সময় লেগে যায়। দেখা যায়, বর্ষাকালে নদীর পানিস্তর বৃদ্ধি ও স্রোতের বেগ বেড়ে যাওয়ায় সেতুর কাঠামোর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। নদীর তলদেশের ভৌগোলিক গঠন এবং মাটির ধরন সেতুর পিলার স্থাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নরম মাটি বা বালুকাময় তলদেশে মজবুত ভিত্তি তৈরি করা কঠিন। সেতুর স্থায়িত্বের জন্য হুমকি তৈরি হয়। আবার নদীর গতিপথের পরিবর্তন বা নদীর পাড় ভাঙন সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড ও কাঠামোকে ঝুঁকিতে ফেলে। এসব প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে উন্নত প্রকৌশল বিদ্যা, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। যমুনা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী ও বিশ্বের দীর্ঘতম নদীগুলোর মধ্যেও অন্যতম। এখানে যমুনা রেলসেতু নির্মাণ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ বটে।
যমুনা রেলসেতুর ব্যপ্তিকাল
বাংলাদেশ রেলওয়ে, জাইকা ও নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে রেলসেতু নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য জানা যায়। ১৯৯৮ সালে
যমুনা নদীর ওপর সড়কসেতু চালু হয়। তখন শেষ মুহূর্তে রেল ট্র্যাক যুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে
ঢাকার সঙ্গে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেলযোগাযোগ স্থাপিত হয়। ২০০৬ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ার পর সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। তখন সেতু দিয়ে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করত।
এ সমস্যার সমাধানে যমুনা নদীর ওপর পৃথক রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলসেতু নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। ২০২৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৫ সাল পর্যন্ত। নতুন রেলসেতু ৫০টি পিলারের ওপর ৪৯টি স্প্যানে নির্মিত হয়েছে। এই সেতুতে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারে। রেলওয়ে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল নির্ধারিত করে দিয়েছে। তবে এর চেয়েও কম গতিতে ট্রেন চলাচল করবে। প্রকল্পটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ রেলওয়ে বাস্তবায়ন করেছে। যৌথভাবে বাংলাদেশ সরকার এবং জাপানের জাইকার আর্থিক ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়।
নির্মাণকাজ
২০২০ সালে জাপানের নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে পশ্চিম (টাঙ্গাইল) দিকের জন্য আইএইচআই-এসএমসিসি ও পূর্বের সিরাজগঞ্জের দিকের জন্য ওবায়াশি-চোয়া-জেএফইকে কাজ দেওয়া হয়। আইএইচআই-এসএমসিসি ৬০৭৫ দশমিক ৭ মিটার নির্মাণ করে। যার মধ্যে ২২৫০ মিটার স্টিলের ট্রাস ব্রিজ, স্টিলের পাইপ শিটের পাইল ফাউন্ডেশন, ভায়াডাক্ট, ট্র্যাক, বাঁধ, স্টেশন ভবন নির্মাণ ও নদী শাসনের কাজ যুক্ত ছিল। ওবায়াশি-চোয়া-জেএফইকে নকশা এবং প্রযুক্তিগত স্পেসিফিকেশন নিম্নস্তরে ৬ দশমিক ৪ কিমি, ওপরের স্তরের ২ দশমিক ৬ কিমি নির্মাণ করে। নদীর অংশের স্টিল শিট পাইল ওয়েল ফাউন্ডেশন স্থাপন করে ২৭ ইউনিট। স্টিল ট্রাস ব্রিজ তৈরি করে। অ্যাপ্রোচ সেকশনে ১ লাখ ৪০ হাজার বর্গমিটার বাঁধ, আরসি/পিসি ব্রিজ ২৫ দশমিক ৮ মিটারসহ ট্র্যাক, বিদ্যমান স্টেশন মেরামত, বিদ্যমান নদীর তীরের শক্তি বৃদ্ধি, অফিস ও ডরমিটরি নির্মাণের কাজ করে।
নকশা ও প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
যমুনা রেলওয়ে সেতুটি একটি ইস্পাতের তৈরি সেতু, যা নদীর ওপর স্থাপিত ৫০টি স্তম্ভের (ভিত্তি) ওপর নির্মিত। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার মূল স্প্যানটি বিস্তৃত সংযোগব্যবস্থার মাধ্যমে টাঙ্গাইল সিরাজগঞ্জের দিকে ৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাবল-ট্র্যাক রাস্তায় যুক্ত করা হয়েছে। মোট সংযোগব্যবস্থার জন্য প্রায় ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ ট্র্যাক স্থাপন করা হয়েছে। ১৬টি অ্যাপ্রোচ ভায়াডাক্ট, ছোট সেতু এবং কালভার্টও স্থাপন করা হয়েছে। সেতুর উপরিভাগের নির্মাণব্যবস্থা বেশ আলাদা। মরিচা প্রতিরোধ ও কম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আবহাওয়া প্রতিরোধী (রংহীন) ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে। কাঠামোটিকে আধুনিকভাবে দ্রুতগতির ট্রেন উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে।
ব্রডগেজ ট্রেন (১৬৭৬ মিলিমিটার) প্রতি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার ও মিটারগেজ ট্রেন (১০০০ মিলিমিটার) প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে চলতে পারবে। প্রধান স্প্যানের উচ্চ শক্তির ইস্পাত ট্রাস উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। অ্যাপ্রোচ এমব্যাঙ্কমেন্ট ও ভায়াডাক্ট রিইনফোর্সড কংক্রিট ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছে। সিগন্যালিং, টেলিযোগাযোগ এবং ট্র্যাক সরঞ্জাম বাংলাদেশ রেলওয়ের মান অনুসারে ইনস্টল করা হয়েছে। মনিটরিং সিস্টেমের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে।
তানভীর মনজুর বলেন, যেকোনো সেতু তৈরির সময় সেতুর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ব্যবহারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। রেলসেতুর মতো বড় সেতু নির্মাণের সময় ৫০ থেকে ১০০ বছর পরের নদীর সম্ভাব্য গতিপথ, নদীভাঙনের সম্ভাব্য তীব্রতা, বন্যার পানির সম্ভাব্য স্তর ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সেতু নির্মাণ করা হয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সেতু নকশার সময় ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টিকেও অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। জলবায়ু বা প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জকে বিবেচনায় রেখে সেতু নির্মাণ করা অত্যন্ত জরুরি, নতুবা প্রত্যাশিত ডিজাইন লাইফ পাওয়া সম্ভবপর হবে না। এ জন্য একটি সেতু নির্মাণের শুরু থেকে উপাদান নির্বাচন ও ডিজাইনকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন অন্যথায় সেতুর লাইফ সাইকেল কস্ট অনেক বেড়ে যেতে পারে। প্রত্যাশিত সেবা বা ব্যবহারের জন্য এই বিষয়গুলো তাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মনিটরিং, নির্মাণের পরে এই রেলসেতুসহ সব বড় সেতুকে যথাযথ পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, যাতে কোনো অসংগতি প্রাথমিক অবস্থাতেই শনাক্তকরণ করা সম্ভব হয়।
প্রকৌশল–পদ্ধতি
উত্তাল নদীর ওপর যেকোনো দীর্ঘ সেতু নির্মাণের জন্য থাকে প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ। প্রবাহিত নদীর নিচে পিলার তৈরি করতে প্রকৌশলীরা স্টিলের পাইপ-শিট পাইল ওয়েল (এসপিএসপি) ব্যবহার করেন। পানিরোধী ক্যাসন তৈরির জন্য ইন্টারলকিং স্টিলের শিট পাইলকে নদীর তলদেশে গভীরভাবে স্থাপন করা হয়। প্রতিটি স্তম্ভের ভিত্তি তৈরি করার জন্য কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। এই কৌশলটি যমুনার স্থানান্তরিত পলি ও বালুর জন্য উপযুক্ত শক্তিশালী স্কয়ার-প্রতিরোধী ভিত্তি প্রদান করে। ভাসমান পাইলিং বার্জ ও বড় হাতুড়ি ব্যবহার করে ৫০টি কূপ পিলারের জন্য বানানো হয়। সুপারস্ট্রাকচারের জন্য প্রতিটি স্টিল-ট্রাস স্প্যান অংশে তৈরি করা হয়। গ্যান্ট্রি ক্রেন ব্যবহার করে ট্রাস অংশকে নামানো হয়। ট্রাস নির্ভুলভাবে সারিবদ্ধকরণ করে বোল্টিং/ওয়েল্ডিং পিয়ারের ওপরে বসানো হয়। ট্রাস ডিজাইনে রেল ডেককে ট্রাস প্যানেলের মধ্যে চলতে দেয়। ট্রাস উচ্চ গ্রেডের আবহাওয়া প্রতিরোধক ইস্পাত ব্যবহার ওজন হ্রাস করে। রঙের প্রয়োজন হয় না। ট্রাস স্থাপনের পর সরাসরি ট্র্যাক স্থাপন করা হয়। অ্যাপ্রোচের কাজের মধ্যে ছিল সেতু পর্যন্ত ৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার নতুন বাঁধ তৈরি করা হয়।
নদী ব্যবস্থাপনা
যমুনা বিশ্বের অন্যতম গতিশীল নদীর মধ্যে একটি। সেতুর স্থানে পানির চাপ ও স্তর ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। রেলসেতুর নকশায় এসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। পিলারের ভিত্তির গভীরতা শুষ্ক মৌসুমের তলদেশের চেয়ে অনেক গভীরে প্রসারিত করা হয়। নদীর প্রবাহের ব্যাঘাত কমাতে স্তম্ভ সুরক্ষিত করা হয়। ডাইভারশন কফারড্যাম ব্যবহার করে নদীর প্রবাহ ও পলি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নদীতীরে প্রয়োজন অনুসারে পাথরের পিচিং ও শিট দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হয়।
গ্রন্থনা: জাহিদ হোসাইন খান