
রাজধানীর ভাটারা থানা থেকে বেরাইদের দিকে প্রায় ১০০ ফুট চওড়া রাস্তাটি বেশ ব্যস্ত। ১০০ ফুট নামে পরিচিত এই রাস্তার দুই পাশে ঘিঞ্জি দোকান আর ছোট ছোট বিপণিবিতান। এই রাস্তার সড়ক বিভাজকটি মোটামুটি চওড়া। ১০০ ফুট সড়ক ধরে এগোলে এই সড়ক বিভাজকের ওপর চোখে পড়ে একটি কবর। আছে কবরস্থানের সাইনবোর্ড। সরু হয়ে বেড়ে ওঠা বট, আম, আতা ও সুপারিগাছের ছায়াবেষ্টিত কবরস্থানটি। কিছুটা দেয়াল দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে। সাইনবোর্ডের লেখা থেকে জানা যায়, কবরটি মো. হানিফ মিয়া নামের এক ব্যক্তির।
গত শনিবার বিকেলে প্রয়াত হানিফ মিয়ার পরিবারের খোঁজ করতে আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। রাস্তায় ভ্যানে খাবার বিক্রি করছিলেন কামাল হোসেন নামের একজন বয়স্ক ব্যক্তি। তিনি বললেন, হানিফ মিয়া এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা আশপাশেই থাকেন। তিনি বাসার ঠিকানা না জানলেও বাসা কোথায় চেনেন। তবে ভ্যান ছেড়ে তাঁর পক্ষে বাসা দেখানো সম্ভব নয়। ঠিক ওই সময় পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ব্যক্তিকে তিনি বাসা চিনিয়ে দিতে বললেন। মো. সেলিম নামের ওই ব্যক্তি একটি গলির ভেতর মো. হানিফ মিয়ার বেয়াইয়ের (চতুর্থ ছেলের শ্বশুর) বাড়িটি চিনিয়ে দিলেন।
ভাটারা থানার কাছের স্থানটির নাম নূরেরচালা। আগে নূরেরচালা গ্রাম হিসেবে জায়গাটি সাঁতারকুল ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পরে ভাটারা ইউপির আওতায় ছিল। নূরেরচালা পূর্ব ও নূরেরচালা পশ্চিম এলাকা এখন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড ও অঞ্চল ৯–এর আওতাভুক্ত।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (অঞ্চল ৯) কাজী জিয়াউল বাসেত প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক বিভাজকে কবরস্থান থাকার বিষয়টি তাঁরা জানেন।
হানিফ মিয়ার বেয়াইয়ের বাড়িটির তিনতলায় গিয়ে পাওয়া গেল হানিফ মিয়ার ছয় ছেলের মধ্যে চতুর্থ ছেলে মো. ওয়ালিউল্লাহর স্ত্রী, নাতনি, বেয়াইনসহ কয়েক স্বজনকে। তাঁর কবর নিয়ে কেন খোঁজ করা হচ্ছে, তাঁরা তা জানতে চান। কবর নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, তা জানতে চান।
এরপর ওই বাড়িতে আসেন হানিফ মিয়ার ছেলে মো. ওয়ালিউল্লাহ। তিনি বলেন, তাঁর বাবার পুরো নাম শেখ মো. হানিফ মিয়া। কবরস্থানে শুধু তাঁর বাবার কবর নয়, তাঁর মা বানেছা বেগম ও তাঁর দ্বিতীয় ছেলে ১০ বছর বয়সী আল আমিনের কবর রয়েছে। সড়কজুড়ে ২০ কাঠা জমি ছিল তাঁদের। তাঁদের বাড়িটি ছিল মাটির। আশপাশে ২৮টির মতো টিনের ও বেড়ার ঘর ভাড়া দেওয়া ছিল। বাসস্থানের পাশেই ছিল কবরস্থান। সরকার জমি অধিগ্রহণের পর কবরস্থানটি অক্ষত রেখে সড়ক নির্মাণ করে।
ওয়ালিউল্লাহ আরও বলেন, তিনি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। বাড়ির বাইরেই বেশি সময় থেকেছেন। তথ্য নিতে তাঁর মেজ ভাইয়ের সঙ্গে পরদিন যোগাযোগ করতে বলেন। পরদিন (গত রোববার) দুপুর ১২টার দিকে কবরস্থানের পাশে কথা হয় হানিফ মিয়ার তৃতীয় সন্তান শেখ মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেনের (৬৪) সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, হানিফ মিয়ার ছয় ছেলে ও চার মেয়ে ছিলেন। এক মেয়ে ৮ বা ৯ বছর আগে মারা গেছেন। এখন গুলশানে যেখানে ডিএনসিসি বিপণিবিতান, সেখানে সরকারি জমিতে টঙের মুদিদোকান ছিল হানিফ মিয়ার। এ ছাড়া তিনি কৃষিকাজ করতেন।
সানোয়ার হোসেন বলেন, বাবার কাছ থেকে শুনেছেন, ব্রিটিশ আমল থেকে এই স্থানে তাঁদের আবাস। এটা গ্রাম ছিল। কবরস্থানে তাঁর মায়ের কবর আগে হয়। কবরস্থানলাগোয়া পশ্চিমে ছিল বাড়িটি। মা মারা যান ২০০৩ সালের ৯ মার্চ। এরপরের বছর ২৭ মার্চ মারা যান বাবা। কাছাকাছি সময়ে বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায় শিশু আল আমিন। ২০১১-১২ সালের দিকে সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে তাঁরা জেলা প্রশাসকের কাছে কবর সংরক্ষণের আবেদন করেন। সরকার কবরস্থান অক্ষত রেখে সড়ক নির্মাণ করে। সড়কের মাঝামাঝি হওয়ায় কবরস্থানটি সড়ক বিভাজকের ওপর কিছুটা বাড়তি জায়গাজুড়ে রাখা হয়।
সানোয়ার হোসেন আরও বলেন, ২০ কাঠা জমির মধ্যে আশপাশ মিলিয়ে কাঠাখানেক জমি অধিগ্রহণের বাইরে পড়েছে। সেখানে দোকান ভাড়া দিয়েছেন। অধিগ্রহণের সময় প্রতি কাঠা বাবদ ২৯ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সরকার। কবরস্থানের উল্টোদিকের গলির ভেতরে তাঁর বাবার কিছু জমি ছিল। সেখানে ভাইয়েরা বাড়ি নির্মাণ করে বাস করছেন। কবরস্থানের পূর্ব পাশে বায়তুল মামুর জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি ছিলেন তাঁর বাবা, এখন তিনি সেই দায়িত্বে।
পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার মতো এই পথ দিয়ে যেতে যেতে কোনো পথিক হয়তো চোখ মুছে যায় না বা পথিকের চরণে কেঁদে উঠে না গাছের পাতার শোক। তবে এত বছর পর কবরস্থানের সামনে মা–বাবা আর ভাতিজার কথা বলতে গিয়ে সানোয়ার হোসেনের চোখ ভিজে ওঠে। ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। বললেন, ‘এ জায়গায় বেড়ে উঠেছি। কত স্মৃতি! রাস্তাটির চারপাশে তাকালে কেমন হাহাকার লাগে!’