Thank you for trying Sticky AMP!!

‘আমার মেয়ে বলছিল, বাবা, জন্মদিনটা কি মৃত্যুদিন হয়ে যাচ্ছে?’

আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার

বড় মেয়ের (১২) জন্মদিন ছিল আজ ১ মার্চ (শুক্রবার)। সে আবদার করেছিল, রাতে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে হবে। রাত ১২টা বাজার পর সেখানেই কেক কেটে জন্মদিন উদ্‌যাপন করবে—এই ছিল মেয়ের ইচ্ছে। তার অনুরোধ মেনে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বেইলি রোডের পাঁচতলার জেস্টি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন। রেস্তোরাঁটি নতুন হয়েছে। তাই সেখানে যাওয়া। তখন রাত সাড়ে নয়টার মতো হবে।

আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং প্রতিষ্ঠানটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান। পরিবেশদূষণ নিয়ে গবেষণার কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানটি। আহমেদ কামরুজ্জামান গতকাল রাতের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বর্ণনা শোনালেন শুক্রবার সকালে। জানালেন ভয়াবহ আগুনের হাত থেকে বেঁচে আসার কথা।

রেস্তোরাঁয় ঢোকার খানিক পরে তাঁরা খাবার অর্ডার দেন। এ সময় কামরুজ্জামান কোনো একটা কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ পাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি একটু উঠে দেখতে গেলাম। খানিকটা হেঁটে জানালার পাশে গেছি। সেখানে গিয়ে দেখি লোকজন জড়ো হয়ে চিৎকার করে রাস্তার উল্টো দিকের একটি ভবন দেখাচ্ছে। অনেকে সেদিক যাচ্ছে। একপর্যায়ে চিৎকার বেড়ে গেল। ইতিমধ্যে আমার স্ত্রীও জানালার কাছে এসে গেছে। এমন সময় হঠাৎ জানালার পাশ থেকে ধোঁয়া উঠল।’

এ ঘটনার পর কামরুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী মারুফা গুলশান আরা সবাইকে জানান, আগুন লেগেছে। তাঁদের নিরাপদে নামতে হবে।

তাঁদের কথা শুনে শোরগোল পড়ে যায়। সবাই মিলে নিচে নামার চেষ্টা করতে থাকেন। সবাই মিলে একতলা পর্যন্ত নিচে নামার পর আর নামতে পারেননি। নিচ থেকে দল বেঁধে লোকজন আসছিল ওপরের দিকে। আর আসছিল ধোঁয়া। তখন তাঁরা সবাই মিলে ছাদে যাওয়ার জন্য উঠতে থাকেন।

Also Read: ঢাকার বেইলি রোডে বহুতল ভবনে ভয়াবহ আগুনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৫ জন, এ পর্যন্ত যা জানা গেল

কামরুজ্জামান বলছিলেন, ‘তখন একটাই ভয় লাগছিল, যদি ছাদের দরজা বন্ধ থাকে তাহলে কী হবে। কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভালো, গিয়ে দেখি ছাদের দরজা খোলা।’

কিন্তু ছাদে গিয়ে বিপত্তি দেখা দিল আশপাশে এই ভবনের লাগোয়া কোনো ভবন নেই। আর ছাদ আছে দুটি রেস্তোঁরা এবং নামাজ পড়ার স্থান। ছাদের তিন-চতুর্থাংশ জায়গাই খালি ছিল না। প্রথমেই তাঁরা ৫০ জনের মতো লোক সেখানে যান। তাঁদের মধ্যে নারীই বেশি। তাঁদের দুই সন্তানসহ শিশু ছিল চারজন। সময় যত যাচ্ছিল আগুনের ধোঁয়া তত ওপরের দিকে উঠছিল। একপর্যায়ে শুধু ধোঁয়া নয়, আগুনের লেলিহান শিখা তখন ছাদের দিকে আসছে। আর শুরু হয়েছে চিৎকার।

আহমেদ কামরুজ্জামান বলছিলেন, ‘ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। কেউ কেউ নিজেদের জামা খুলে পানিতে ভিজিয়ে চোখে–মুখে দিচ্ছিলেন। আগুন কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ লাফ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আমার স্ত্রী ও আমি মিলে তাঁদের বললাম, এখনো তো আমাদের বাঁচার সুযোগ আছে। কিন্তু এত উঁচু থেকে লাফ দিতে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। একটু দেখি ফায়ার সার্ভিস আসে কি না।

Also Read: বেইলি রোডে আগুন: পরিচয় মিলেছে ৪০ জনের, লাশ হস্তান্তর ৩৫ জনের

কিন্তু চিৎকারে, আহাজারিতে তখন চারদিকে ভয়ানক পরিস্থিতি হয়ে ওঠে। আমি শুনেছি, ছাদে থাকা দুজন লাফ দিয়েছিলেন। আমার মেয়েরা দেখেছে। এরপর থেকে ওরা ট্রমাটাইজড হয়ে গেছে। এখনো কথা বলতে পারছে না।’

অনেকেই তখন সেখানে নামাজে বসে যান, প্রার্থনা শুরু করেন বাঁচার আকুতিতে। ওই ছাদে তখন অনেক কাপড় শুকাতে দেওয়া ছিল। কামরুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী মিলে সেগুলো নিচে ফেলে দিতে থাকেন। কারণ, দাহ্য বস্তু পেলে আগুন দ্রুত আসবে।

একপর্যায়ে ছাদের রেস্তোরাঁয় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তখন চিৎকার আরও বাড়ে। আহমেদ কামরুজ্জামান বলছিলেন, ‘তখন আমার বড় মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, বাবা, আমার জন্মদিন কি মৃত্যুদিন হয়ে যাচ্ছে? আমরা সন্তানসহ সবাইকে প্যানিকড না হওয়ার জন্য বারবার বলতে থাকি। আমার স্ত্রীও সাহসিকতার সঙ্গে অন্যদের বোঝাতে থাকেন।’

আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট কাজ করে

Also Read: সন্তানদের নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন মা, মর্গে হলো তাঁদের ঠিকানা

আগুনে যখন পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, তখন নিচ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কথা শুনতে পান ছাদের লোকেরা। তাঁরা বলছিলেন, ক্রেনের দিকে চলে আসতে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন কোন দিকে তা কেউ দেখতে পাচ্ছিলেন না। এমন সময় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী ছাদে উঠে আসেন। তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করতে থাকেন। ওই কর্মী একপর্যায়ে একটি হাতুড়ির মতো বস্তু নিয়ে ছাদের একটি রেস্তোরাঁর দরজা ভেঙে ফেলেন, যাতে আগুন না আসে।

চারদিকের আগুনে ইতিমধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে সেখানে পড়ে যান। একপর্যায়ে ক্রেনের দেখা পান তাঁরা। তখন রাত প্রায় ১২টা বেজে গেছে। প্রথম ক্রেনে চারটি শিশু ও নারী এবং অসুস্থ কয়েকজনকে তুলে দেওয়া হয়। প্রথমে ক্রেনে বেশি লোক নিলেও পরে চার–পাঁচজন করে নেওয়া হয়। ১০ থেকে ১২ দফায় সবাইকে নামানো হয়।

আহমেদ কামরুজ্জামানের সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে। তাঁর কণ্ঠস্বরে তখনো ক্লান্তি। তিনি বলছিলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমাদের উদ্ধার করেছে। তারা সময়মতো না এলে আজ হয়তো এসব কথা বলতেই পারতাম না। আমার মেয়ে দুটো এখনো কোনো কথা বলতে পারছে না, ভয়ে।’

Also Read: চার বন্ধু মিলে বেইলি রোডে গিয়েছিলেন নাজমুল, তাঁর সন্ধান পাচ্ছেন না বাবা

Also Read: ইতালি ফেরার আগে স্ত্রী–তিন সন্তানকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন, আগুনে প্রাণ গেল সবার