শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রের উৎস ও জোগানদাতাকে খুঁজছে পুলিশ। পাশাপাশি হামলাকারীদের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাতে সহযোগিতাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হামলায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি এখনো উদ্ধার হয়নি। অস্ত্র উদ্ধার ও জোগানদাতাকে গ্রেপ্তার করা গেলে এই হত্যার নেপথ্যের অনেক তথ্য জানা যাবে।
হাদিকে হত্যাচেষ্টার মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাদির ওপর হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি এখনো উদ্ধার হয়নি। তাঁরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।
রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় গত শুক্রবার চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে দুর্বৃত্তরা রিকশায় থাকা হাদিকে গুলি করে। তিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাদিকে গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়।
হাদির ফেসবুক পেজে গতকাল মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে থাকা তাঁর ভাইয়ের বরাত দিয়ে জানানো হয়, সেখানকার হাসপাতালে প্রাথমিক পরীক্ষার পর হাদির শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি দেখা গিয়েছিল। তবে তা স্থিতিশীল হয়েছে। তাঁর আরেকটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। তবে সেটা করার মতো শারীরিক অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি।
হাদির ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত মূল সন্দেহভাজন নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সল করিম মাসুদ ও তাঁর সহযোগী আলমগীর শেখ। তাঁরা দুজন ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছে তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র। এদিকে গতকাল ফয়সলের বাবা হুমায়ূন কবিরকে আটক করা হয়েছে। হাদির ওপর হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে তিনি জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, হাদিকে গুলি করার পর ফয়সল ও আলমগীর মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁর (ফয়সল) বোনের বাসা আগারগাঁওয়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে হুমায়ূন কবির বাসা থেকে মোটরসাইকেলের একটি নম্বর প্লেট এনে দেন। বাসার গ্যারেজে মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটটি পরিবর্তন করা হয়। ফয়সল ও আলমগীরকে আমিনবাজার যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে দেন হুমায়ূন কবির। ঘটনার দিন তিনি ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পরে ১০ থেকে ১২ বার বাসার বাইরে বেরিয়েছেন। এটা তদন্তকারীদের কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে।
ফয়সলকে গাড়ি ঠিক করে দেওয়া নুরুজ্জামানকেও গতকাল আটক করা হয়। তিনি ভাড়ায় চালিত গাড়ির ব্যবসা করেন। তাঁর বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। সূত্র বলছে, হাদির ওপর হামলার আগেই পালানোর জন্য একটি ভাড়া করা গাড়ি রমনা এলাকায় এনে রাখেন ফয়সল। পরিকল্পনা ছিল হামলার পর মোটরসাইকেল ফেলে ওই গাড়িতে করে পালিয়ে যাবেন তাঁরা; কিন্তু সেই পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয়।
রমনায় রাখা গাড়িটি মানিকগঞ্জ যাওয়ার কথা বলে ছয় হাজার টাকায় ভাড়া করা হয়েছিল বলে তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রের ভাষ্য। ওই গাড়ির চালক ছিলেন সুমন নামের এক ব্যক্তি। সূত্র আরও জানায়, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সুমন গাড়ি নিয়ে মৎস্য ভবন এলাকায় যান। তবে ফয়সল যাননি। বেলা ১টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর সুমন ফোন করেন নুরুজ্জামানকে। নুরুজ্জামান ফয়সলের সঙ্গে কথা বলে সুমনকে গাড়ি নিয়ে ধামরাইয়ের কালামপুর এলাকায় যেতে বলেন। সুমন গাড়ি নিয়ে কালামপুর গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে ফয়সল ও আলমগীর সেখানে গিয়ে সুমনের গাড়িতে ময়মনসিংহ যান। গাড়িচালক সুমনকে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দেন ফয়সল।
ফয়সল ও আলমগীর ময়মনসিংহ যাওয়ার সময় গাড়িচালক সুমনের মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএসএফ) নম্বরে ৩০ হাজার টাকা আনেন বলে সূত্র জানিয়েছে। নরসিংদীর এক ব্যক্তি এই টাকা পাঠিয়েছেন। তাঁকে খুঁজছে পুলিশ।
সব মিলিয়ে হাদির ওপর হামলায় ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৯ জনকে আটক ও গ্রেপ্তারের তথ্য জানা গেছে। হুমায়ূন কবির ও নুরুজ্জামান ছাড়া অন্যরা হলেন ফয়সলের সহযোগী মো. কবির, ফয়সলের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু ও ফয়সলের বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা, মোটরসাইকেলের মালিক সন্দেহে আবদুল হান্নান এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তার অভিযোগে সঞ্জয় চিসিম ও সিমিরন দিও।
রোববার দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলী এলাকায় একটি ইটভাটার ছনের ঘর থেকে কবিরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সে সময় র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কবির রাজধানীর আদাবর থানা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি ওয়ার্ড শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক। গতকাল কবিরকে আদালতে তোলা হয়। পুলিশ বলছে, যে মোটরসাইকেল ব্যবহার করে হাদিকে গুলি করা হয়, সেটির মালিক কবির। তবে কবির আদালতে দাবি করেন, মোটরসাইকেলটি তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে এক বন্ধু কিনেছে। তিনি মোটরসাইকেল চালিয়ে পরিবার চালান। ফয়সলকে ভাড়ার বিনিময়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। এর আগে মোটরসাইকেলের মালিক সন্দেহে আবদুল হান্নান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে সন্দেহভাজন ফয়সল ও আলমগীরকে ভারতে পালাতে সহায়তাকারী ফিলিপ স্নালকে ধরা যায়নি। তিনিও ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
৪ ডিসেম্বর থেকে ফয়সল, আলমগীর ও জাকির নামের তিন তরুণ হাদির জনসংযোগে নিয়মিত অংশ নিতেন। তবে প্রথম আলোর ‘ছক কষা হচ্ছিল কয়েক মাস ধরে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে গত রোববার জাকিরের নামটি রুবেল হিসেবে ছাপা হয়েছিল। ইনকিলাব মঞ্চের নেতা–কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা ওই ব্যক্তি জাকির বলে নিশ্চিত করেছেন।