প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সোনাদিয়ায় ৪ হাজার একর প্যারাবন ধ্বংস করে ৪৪টি চিংড়িঘের নির্মাণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বন পরিদর্শন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি দল। আজ দুপুরে তোলা
প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সোনাদিয়ায় ৪ হাজার একর প্যারাবন ধ্বংস করে ৪৪টি চিংড়িঘের নির্মাণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বন পরিদর্শন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি দল। আজ দুপুরে তোলা

সোনাদিয়ায় তিনটি চিংড়িঘেরের স্থাপনা উচ্ছেদ, অক্ষত বেড়িবাঁধ

কক্সবাজারের মহেশখালীর প্ররিবেশ সংকটাপন্ন সোনাদিয়া দ্বীপে অভিযান চালিয়ে প্যারাবন ধ্বংস করে নির্মিত তিনটি চিংড়িঘেরের অস্থায়ী স্থাপনা ( ঘর-গুদাম) গুড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। তবে কাটা হয়নি ঘেরের বাঁধ। দখলদারদের কাউকে আটকও করা হয়নি।

আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ প্যারাবন ধ্বংসের চিত্র দেখতে সোনাদিয়ায় যান। তাঁর সঙ্গে অভিযানে অংশ নেন পুলিশ, বন বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। পরিদর্শনকালে প্যারাবনের গাছপালা ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণ এবং আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছপালা দেখতে পান দলের সদস্যরা। এ সময় তিনটি চিংড়িঘেরের অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।

এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর শেষ পৃষ্টায় ‘ প্যারাবন পুড়িয়ে নতুন চিংড়িঘের’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সংকটাপন্ন সোনাদিয়া দ্বীপে নতুন করে অন্তত এক হাজার একরের প্যারাবনের কেওড়া ও বাইনগাছ ধ্বংস করে তৈরি হয়েছে সাতটি চিংড়িঘের। এবার প্রকাশ্যে পেট্রল ঢেলে গাছপালা পুড়িয়ে এসব ঘের করা হয়েছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৩ হাজার একরের বেশি প্যারাবন ধ্বংস করে সেখানে নির্মিত হয়েছিল ৩৭টি চিংড়িঘের। এসব ঘের উচ্ছেদ করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও গত ছয় মাসে তা কার্যকর হয়নি। এখন চিংড়িঘেরের সংখ্যা ৪৪।

সোনাদিয়া থেকে ফিরে আজ বিকেলে ইউএনও মো. হেদায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, সরেজমিন পরিদর্শনের সময় প্যারাবনের গাছ কেটে চিংড়িঘের নির্মাণের সত্যতা পাওয়া গেছে। এমনকি গতকাল বিকেলেও আগুন দিয়ে গাছপালা পোড়ানো হয়েছে। আজ ঘটনাস্থলে গিয়ে তার চিহ্ন দেখা গেছে।

দখলদারদের কেউ ধরা না পড়ার কারণ জানতে চাইলে ইউএনও মো. হেদায়েত উল্যাহ বলেন, আজকের অভিযানে তিনটি চিংড়িঘেরের অস্থায়ীভাবে তৈরি বেশ কিছু স্থাপনা ( ঘর-গুদাম) গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযানে নামার পর ঘেরের দখলদার ও শ্রমিকেরা পালিয়ে পাশের প্যারাবনে আত্মগোপন করেন। এ কারণে কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এ সময় গাছ কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। তা ছাড়া দুটি চিংড়িঘেরে পানি চলাচলের স্লুইসগেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগুন দিয়ে প্যারাবন পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা করতে বন বিভাগকে বলা হয়েছে।

অভিযানে অংশ নেওয়া মহেশখালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুমিত বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপে কী পরিমাণ ধ্বংস যজ্ঞ চালানো হয়েছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্যারাবন দখল করে চারদিকে বেড়িবাঁধ দিয়ে চিংড়িঘের নির্মাণের পর ভেতরের গাছপালা রাতের আঁধারে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে।

চিংড়িঘেরের জন্য পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্যারাবনের গাছপালা। পুড়ে গেছে ঘাসও। আজ দুপুরে কক্সবাজারের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপ সোনাদিয়ায়

ইউএনও মো. হেদায়েত উল্যাহ বলেন, মহেশখালী সদর থেকে সোনাদিয়ার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। প্যারাবন দখলের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দখলদারের দল পালিয়ে যায়। বিশাল প্যারাবন দেখভালের কেউ থাকে না। প্যারাবন দেখভালের জন্য সোনাদিয়া দ্বীপে স্থায়ী একটি বন বিট স্থাপন করা জরুরি। তা না হলে সোনাদিয়ার অবশিষ্ট প্যারাবনও রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

কক্সবাজার শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়া। লাল কাঁকড়া, কাছিম ও বিরল পাখির কারণে এই দ্বীপ সুপরিচিত। সোনাদিয়া দ্বীপটিকে ২০০৬ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। মানে সেখানকার মাটি, পানি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।

ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সোনাদিয়ার ৯ হাজার ৪৬৬ দশমিক ৯৩ একর বনভূমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে প্যারাবন পড়েছে অন্তত ৮ হাজার একর। ২০১৭ সালের মে মাসে বেজা উপকূলীয় বন বিভাগের কাছ থেকে তা অধিগ্রহণ করে। কিন্তু কয়েক বছরে বেজা সেখানে ইকো-ট্যুরিজমের কিছুই করেনি। গত বছর আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা বেজা নিয়ন্ত্রিত ৩ হাজার একরের বেশি প্যারাবন ধ্বংস করে ৩৭টির বেশি চিংড়িঘের নির্মাণ করে। বেজা দখলদারের বিরুদ্ধে তখন একটিও মামলা করেনি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে পরবর্তী কয়েক মাসে আরও এক হাজারের বেশি প্যারাবন ধ্বংস করে সাতটি চিংড়িঘের নির্মাণ করেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা।

পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’ কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, আগের তৈরি ৩৭টি ঘেরে শত কোটি টাকার চিংড়ি রয়েছে। নতুন তৈরি সাতটি ঘেরেও আগামী জুন মাস থেকে চিংড়ির পোনা ছাড়া হবে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করে ঘেরের বাঁধগুলো কেটে দিলে ঘেরের সব চিংড়ি সাগর-নদীতে ছড়িয়ে পড়ত। তাতে সাধারণ মানুষ লাভবান হতো। কিন্তু ঘেরের বাঁধ কাটতে কেউ রাজি নয়।