ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের পর নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানা। গত বছরের ৬ আগস্ট তোলা
ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের পর নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানা। গত বছরের ৬ আগস্ট তোলা

‘গুলি খাই জাগাত মরি গেছে হাঁচজন, আরও কতজন গুলি খাইছে তার ঠিক নাই’

গত বছরের ৫ আগস্ট নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানা এলাকায় পুলিশের গুলিতে স্থানীয় পাঁচ বাসিন্দা নিহত হন। একই দিনে নিহত হয়েছেন পুলিশের দুজন। পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন ইয়াছিন আরাফাত (১৪), মোহাম্মদ হাসান (১৩), মাঈন উদ্দিন (৩৮), তানভির হোসেন (২৫) ও আসিফ হোসেন (২৬)।

‘বেলা তিনটা কি সাড়ে তিনটা অইবো। আমি দোকানের সামনে দাঁড়াই ছিলাম। হঠাৎ দেখি দক্ষিণ দিগেত্তুন একটা মিছিল আইতেছে। সবাইর হাতে লাডিসোডা। মিছিলের লোকজন থানার দিকে ঢিল ছুইটতে ছুইটতে আইতেছিল। থানার গেট বন্ধ থাকায় কেউ ডুইকতো হারে ন। এমন সময় থানার দুইতালার ছাদেরত্তুন পুলিশ গুলি শুরু করে। থানার গেটের সামনেই গুলিখাই হড়ি যায় কয়েকজন। রক্তে লাল অই যায় থানার সামনের কালা পাকা রাস্তা।’

গত বছরের ৫ আগস্ট নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানায় হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনার এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইমাম হোসেন (৫৫)। থানার সামনের কুমিল্লা-নোয়াখালী বাইপাস সড়কের পশ্চিম পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতাল–সংলগ্ন এলাকায় চা-নাশতার দোকান রয়েছে তাঁর। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়।

ইমাম হোসেন বলেন, ‘এলাকায় গুজব ছড়ি হইড়ছিল থানার ভিতরে আমীলীগের (আওয়ামী লীগ) কিছু নেতা হলাই রইছে। হিয়াল্লাই লোকজন খেপি আছিল। হিয়ার মধ্যে থানারত্তুন পুলিশ গুলি কইরলে যন দুই-তিনজন মরি যায়, তন মানুষ আরও খেপি যায়। চারদিকেত্তুন মানুষ যে যা হাতের কাছে হাইছে, হেইডা লই থানার দিকে যায়। তখন পুলিশ আরও মারমুখী হই নির্বিচার গুলি করে। গুলি খাই জাগাত মরি গেছে হাঁচজন, আরও কতজন গুলি খাইছে তার ঠিক নাই। হিয়ার হরে মানুষজন থানার ভিতরে আগুন দেয়।’

গত বছরের ৫ আগস্ট নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানা এলাকায় পুলিশের গুলিতে স্থানীয় পাঁচ বাসিন্দা নিহত হন। একই দিনে নিহত হয়েছেন পুলিশের দুজন। পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন ইয়াছিন আরাফাত (১৪), মোহাম্মদ হাসান (১৩), মাঈন উদ্দিন (৩৮), তানভির হোসেন (২৫) ও আসিফ হোসেন (২৬)। পুলিশের যে দুজন নিহত হয়েছেন তাঁরা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) বাছির উদ্দিন ও কনস্টেবল মো. ইব্রাহিম।

ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইমাম হোসেন জানান, ৫ আগস্ট সকাল থেকে সোনাইমুড়ী জিরো পয়েন্ট ও বাইপাস এলাকায় ছাত্র-জনতার মিছিল হয়েছে। দুপুরে যখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবর এল, তখনো সবাই বিজয় মিছিল করেছে। সেখানেও অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি; কিন্তু বেলা তিনটার দিকে থানার সামনে আসা মিছিলটি সবকিছু উল্টে পাল্টে দেয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের থানায় আশ্রয় নেওয়ার গুজব ছিল আগুনে ঘি ঢালার মতো।

এলাকায় গুজব ছড়ি হইড়ছিল থানার ভিতরে আমীলীগের (আওয়ামী লীগ) কিছু নেতা হলাই রইছে। হিয়াল্লাই লোকজন খেপি আছিল। হিয়ার মধ্যে থানারত্তুন পুলিশ গুলি কইরলে যন দুই-তিনজন মরি যায়, তন মানুষ আরও খেপি যায়। চারদিকেত্তুন মানুষ যে যা হাতের কাছে হাইছে, হেইডা লই থানার দিকে যায়।
—ইমাম হোসেন, প্রত্যক্ষদর্শী

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই দিন একপর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ সদস্যদের কেউ থানার পেছনের দেয়াল টপকে, কেউ নালার ভেতর দিয়ে, থানা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এসআই বাছির উদ্দিন থানা থেকে দৌড়ে পার্শ্ববর্তী বাসায় গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ে যান। সেখানে তাঁকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। থানার পেছন দিয়ে পালানোর সময় ইব্রাহিম নামের কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

সোনাইমুড়ী থানায় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে বেলা সোয়া তিনটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত। দোতলাবিশিষ্ট থানা ভবনের পুরোটাই পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। থানার সামনে থাকা সরকারি গাড়িসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়। হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ থেকে বাদ যায়নি থানার কর্মচারীদের আবাসনের জন্য নির্মিত বাসাবাড়িসহ অন্যান্য ভবনও। চার হাজারের বেশি গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলার নথিপত্রও পুড়ে যায়।

ছেলের কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত কিশোর ইয়াছিন আরাফাতের মা পাখি বেগম। সম্প্রতি তোলা

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা পাখি

সোনাইমুড়ীর ভানুয়াই গ্রামের দম্পতি মো. হানিফ ও পাখি বেগম। তিনটি মেয়ের পর তাঁদের ঘরে জন্ম হয় ছেলে ইয়াছিন আরাফাতের। তাই পরিবারে বাড়তি আদর-যত্ন ছিল তার জন্য। একমাত্র ছেলেটি গত বছরের ৫ আগস্ট সোনাইমুড়ী থানার সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই দিন একপর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ সদস্যদের কেউ থানার পেছনের দেয়াল টপকে, কেউ নালার ভেতর দিয়ে, থানা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এসআই বাছির উদ্দিন থানা থেকে দৌড়ে পার্শ্ববর্তী বাসায় গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ে যান। সেখানে তাঁকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। থানার পেছন দিয়ে পালানোর সময় ইব্রাহিম নামের কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ছেলের কথা বলতেই কেঁদে ওঠেন পাখি বেগম। বলেন, তাঁর স্বামী অসুস্থ। তাই ছেলেকে পড়ালেখা করানোর ইচ্ছা থাকলেও সেটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরিবারের অবস্থা দেখে কিশোর ছেলেটি গ্যাসের চুলা, বৈদ্যুতিক পাখা ও ফ্রিজ মেরামতসহ কিছু কাজ শিখে উপার্জন করত। ইয়াছিনের আয়েই চলত পরিবার। এখন ইয়াছিনও নেই, পরিবারের কোনো আয়ও নেই।

পাখি বেগম বলেন, ইয়াছিনের পর আরও একটি মেয়ে সন্তান হয় তাঁর। অভাবের কারণে এখন চার মেয়ের মধ্যে দুজনকে দত্তক দিয়েছেন। গ্রামে অন্যের তৈরি করে দেওয়া একটি ঘরে বসবাস করছেন স্বামী ও বাকি দুই সন্তানকে নিয়ে। আয় না থাকায় খুবই অসহায় দিন কাটছে তাঁর।

দুই শিশুসন্তান নিয়ে অনটনে নুর নাহার

সোনাইমুড়ী উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের মাঈন উদ্দিন গত বছরের ৫ আগস্ট বিজয় মিছিল দেখতে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে অল্প দূরে অবস্থিত থানার সামনে। এরই মধ্যে থানা থেকে ছোড়া একটি গুলি লাগে তাঁর বুকের বাঁ পাশে। মুহূর্তেই তিনি লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর।

হাসানসহ দুই ছেলে দুই মেয়ে আছিল আঁর। হাসান শহীদ অই যাইবার হর অন এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। হিগুনেরে লই দিন কাডে কোনো রকমে। সারাক্ষণ হাসানের চেয়ারা চোখের সামনে ভাসে। এক মুহূর্তের লাইও ছেলেরে ভুইলতাম হারি না। ছেলের কতা মনে অইলেই বুক হাডি কাঁন্দন আইয়ে।
— শাহীনা আক্তার, মোহাম্মদ হাসানের মা

মাঈন উদ্দিনের স্ত্রী নুর নাহার বলেন, তাঁর স্বামী মাইক্রোবাস চালাতেন। স্বামীর উপার্জনেই চলত তাঁদের সংসার। এখন আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিয়ে পরিবার চলছে। তাঁর ঘরে মো. সিফাত উদ্দিন (৮) নামে এক ছেলে এবং ইসফিয়া আক্তার (৬) নামে এক মেয়ে রয়েছে। সন্তানদের নিয়ে অভাব-অনটনে দিন কাটছে তাঁর।

কিশোর হাসানের জন্য কান্না থামেনি মায়ের

সোনাইমুড়ী থানার সামনে গুলিতে নিহতদের একজন কিশোর মোহাম্মদ হাসান। মৌসুমি ফল বিক্রি করত সে। তার মৃত্যুর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তার মা শাহীন আক্তার। হাসানের কথা উঠলেই এখনো কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

শাহীনা আক্তার জানান, বাড়ির পাশের সড়ক দিয়ে আনন্দমিছিল যেতে দেখে সেখানে যোগ দেয় হাসান। গুলির শব্দ শুনে ছেলেকে বাড়ির বাইরে না যেতে নিষেধ করেছিলেন তিনি। ছেলে সেই নিষেধ শোনেনি। পরে লাশ হয়ে ফিরেছে ছেলে।

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত হাসান পড়ালেখা করেছে জানিয়ে শাহীনা আক্তার বলেন, নিজে নিজেই ভ্যানগাড়িতে মৌসুমি ফল বিক্রি শুরু করেছিল হাসান। স্বামী ছোট একটি দোকান করে সংসার চালান, আয় কম, তাই ছেলেকেও রোজগার করতে নিষেধ করেননি। তার আয়ে সংসারের অভাব কিছুটা কেটেছিল।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে শাহীনা আক্তার বলেন, ‘হাসানসহ দুই ছেলে দুই মেয়ে আছিল আঁর। হাসান শহীদ অই যাইবার হর অন এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। হিগুনেরে লই দিন কাডে কোনো রকমে। সারাক্ষণ হাসানের চেয়ারা চোখের সামনে ভাসে। এক মুহূর্তের লাইও ছেলেরে ভুইলতাম হারি না। ছেলের কতা মনে অইলেই বুক হাডি কাঁন্দন আইয়ে।’

ছেলের মৃত্যুর পর সরকারিভাবে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ধারদেনা পরিশোধ করেছেন। স্বামীর সামান্য আয়ে এখন কোনোমতে সংসার চলছে বলে জানান শাহীন আক্তার।

মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ইব্রাহিমের স্ত্রী

থানার পেছনে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কনস্টেবল ইব্রাহিমকে। তাঁর একমাত্র মেয়ের বয়স তিন বছর। ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকছেন তাঁর স্ত্রী রোকেয়া আক্তার। মুঠোফোনে রোকেয়া আক্তার বলেন, স্বামীকে হারিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন তিনি। তিন বছর বয়সী মেয়ে রুবাইদা ইসমাতকে নিয়ে এখন চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ এলাকায় তাঁর বাবার বাড়িতে রয়েছেন।

রোকেয়া আক্তার জানান, ৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তাঁর সঙ্গে স্বামী ইব্রাহিমের সর্বশেষ কথা হয়। থানায় আক্রমণের খবর এর আগেই ইব্রাহিম তাঁকে খুদে বার্তার মাধ্যমে জানিয়েছেন। সাড়ে সাতটার পর ফোন বন্ধ হয়ে যায়। আর যোগাযোগ করতে পারেননি। পরের দিন সকালে হাসপাতালের মর্গ থেকে তাঁকে ফোন করে স্বামীর মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে।

দুই মামলায় গ্রেপ্তার ২৩, উদ্ধার হয়নি সব অস্ত্র

পুলিশসহ সাতজন নিহত হওয়া এবং সোনাইমুড়ী থানায় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে একটির বাদী গুলিতে নিহত ছাত্রদলকর্মী আসিফ হোসেনের বাবা মো. মোরশেদ আলম। আর অন্যটির বাদী পুলিশ। দুটি মামলার মধ্যে আসিফের বাবার করা মামলায় এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী, নোয়াখালীর সাবেক পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান রয়েছেন। পুলিশ বাদী হয়ে করা মামলাটিতে গ্রেপ্তার রয়েছে সাতজন। যার মধ্যে তিনজন আসামি এরই মধ্যে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

এদিকে এ ঘটনার এক বছর পার হতে চললেও এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র। অস্ত্রগুলোর মধ্যে চারটি চায়না রাইফেল, একটি এসএমজি, তিনটি পিস্তল, পাঁচটি শটগান এবং প্রায় আড়াই হাজার গুলি। সোনাইমুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, নিহত আসিফের বাবা মোরশেদ আলমের করা মামলাটি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন তদন্ত করছেন। তবে থানায় হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ হত্যার মামলাটির তদন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশে বন্ধ রয়েছে।