
ছয় বছরে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ছয়টি বড় ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে অন্তত ৫৩ জনের। আহত হয়েছেন শতাধিক যাত্রী। এসব ঘটনায় রেলওয়ের তদন্ত কমিটি প্রতিবারই দায় চাপিয়েছে ট্রেনচালক, সহকারী চালক, গার্ড ও গেটম্যানদের ওপর।
ছয় বছরে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ছয়টি বড় ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে অন্তত ৫৩ জনের। আহত হয়েছেন শতাধিক যাত্রী। এসব ঘটনায় রেলওয়ের তদন্ত কমিটি প্রতিবারই দায় চাপিয়েছে ট্রেনচালক, সহকারী চালক, গার্ড ও গেটম্যানদের ওপর। তবে বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, ট্রেন পরিচালনার নিচের সারির কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অবহেলার কোনো জবাবদিহি হচ্ছে না।
সর্বশেষ ৫ জুন রাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সাতটি গাড়িতে ধাক্কা দেয় কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস। এতে অটোরিকশাচালক তৌহিদুল ইসলাম ও দুই বছরের শিশু মেহেরিমা নূরের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ১৬ জন।
রেলওয়ে ট্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত দল গঠন করলেও এসব তদন্তে উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। তাই সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করে ট্রেন দুর্ঘটনার মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে।মো. সামছুল হক, পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট
রেলওয়ের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, ট্রেনটি সেতুতে ওঠার নিয়ম না মেনে সংকেত অমান্য করে দ্রুতগতিতে ঢুকে পড়ে। এ ঘটনায় পর্যটক এক্সপ্রেসের লোকোমাস্টার গোলাম রসুল, সহকারী লোকোমাস্টার আমিন উল্লাহ, গার্ড সোহেল রানা ও অস্থায়ী গেটকিপার মাহবুবকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
ট্রেন পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত। একটি অঞ্চল যমুনা নদীর পূর্ব পাশে, যা পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে (ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-ময়মনসিংহ বিভাগ) হিসেবে পরিচিত। আর যমুনা নদীর পশ্চিম পাশ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে গঠিত (রাজশাহী-রংপুর-খুলনা বিভাগ)।
ছয় দুর্ঘটনা, একই তদন্ত ধারা
রেলওয়ের তথ্য বলছে, পূর্বাঞ্চল রেলপথে ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর ভৈরবে আন্তনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ও একটি মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত হন ১৯ জন। আহত হন অন্তত ৫০ জন। ওই ঘটনায় চালক, সহকারী চালক ও গার্ড সংকেত ভালোভাবে লক্ষ্য না করায় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মন্দবাগ স্টেশনে সংঘর্ষ হয় চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ও ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথার। এতে ১৬ যাত্রী প্রাণ হারান। তদন্ত প্রতিবেদনে তূর্ণা নিশীথার চালক ও গার্ডকে দায়ী করা হয়।
সর্বশেষ ৫ জুন রাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সাতটি গাড়িতে ধাক্কা দেয় কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস। এতে অটোরিকশাচালক তৌহিদুল ইসলাম ও দুই বছরের শিশু মেহেরিমা নূরের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ১৬ জন।
২০২২ সালের ২৯ জুলাই মিরসরাইয়ে মাইক্রোবাসের সঙ্গে মহানগর প্রভাতীর সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হন। এ ঘটনায় মাইক্রোবাসচালক ও গেটম্যানকে দায়ী করে দুটি তদন্ত কমিটি।
এর আগে ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের খুলশীর ঝাউতলা রেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের অবহেলায় ডেমু ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়।
২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস পেছন থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দেয়। কেউ মারা না গেলেও আহত হন অন্তত ৫০ জন। তদন্তে চালকের সংকেত অমান্য করার বিষয় উঠে আসে।
এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের কেবল সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সবুক্তগীন বলেন, কালুরঘাট দুর্ঘটনায় চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ হচ্ছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার তদন্ত হয় এবং যেখানে গাফিলতির প্রমাণ মেলে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মো. সবুক্তগীন আরও জানান, নিয়মিতভাবে ট্রেনচালকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শুধু কর্মীদের শাস্তি নিয়ে প্রশ্ন বিশেষজ্ঞের
যে ছয় বড় ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে ট্রেনচালক, সহকারী ট্রেনচালক, গার্ড ও গেটম্যানদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবহনবিশেষজ্ঞ মো. সামছুল হক।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেল দুর্ঘটনার জন্য যাঁদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা ট্রেন পরিচালনা চক্রের একেবারে নিচু সারির কর্মী। তাঁরা ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য উপসর্গ, মূল কারণ নয়। তাঁদের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই কিন্তু দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। এই কর্তারা ক্রমাগতভাবে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। পেশাদারি দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাঁদের জবাবদিহির আওতায় না এনে নিচু সারির কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
রেলওয়ের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে পরিবহনবিশেষজ্ঞ মো. সামছুল হক বলেন, রেলওয়ে ট্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত দল গঠন করলেও এসব তদন্তে উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। তাই সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করে ট্রেন দুর্ঘটনার মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে।