
স্তন ক্যানসারের রিস্ক ফ্যাক্টর বলতে আমরা বুঝি ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয় এমন কারণগুলো। এগুলো দুইভাবে ভাগ করা যায়। একটি হলো জেনেটিক কারণ, যেমন ‘বিআরসিএ১’ ও ‘বিআরসিএ২’ জিনে মিউটেশন থাকলে ব্রেস্ট ক্যানসারের আশঙ্কা বেড়ে যায়। আরেকটি হলো, নন-জেনেটিক কারণ। তবে প্রাথমিক পর্যায়েই ক্যানসার শনাক্ত করার জন্য নিয়মিত স্ক্রিনিং জরুরি।
‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. মো. নাহিদ হোসেন। উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন। ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে এসকেএফ অনকোলজি।
এবারের আলোচনায় মেডিকেল অনকোলজি, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি ও ইমিউন থেরাপিসহ স্তন ক্যানসারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন চিকিৎসক। পর্বটি গত বুধবার (২৯ অক্টোবর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
স্তন ক্যানসার এবং এটি হওয়ার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে শুরুতেই চিকিৎসকের কাছে জানতে চান উপস্থাপক। উত্তরে ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, আসলে যেকোনো ক্যানসারই হলো শরীরের কোনো সেল বা কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। যদি সেই কোষের গ্রোথ অনিয়ন্ত্রিতভাবে হয়, সেটাই ক্যানসার। আর স্তন ক্যানসারও একইভাবে ঘটে—যখন ব্রেস্টের সেলগুলোর আনকন্ট্রোলড গ্রোথ হয়।
ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, সাধারণত দুই ধরনের ব্রেস্ট ক্যানসার বেশি দেখা যায়—ডাক্টাল কারসিনোমা, যা দুধ বহনকারী ডাক্টে ক্যানসার হলে। অন্যটি লোবুলার কারসিনোমা, যা ব্রেস্টের দুধ উৎপাদনকারী গ্ল্যান্ডে ক্যানসার হলে।
নন–মডিফায়েবল কারণগুলো সম্পর্কে ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, ‘এগুলো হলো, মেয়েদের অল্প বয়সে অর্থাৎ ১২ বছরের আগে মাসিক শুরু হওয়া, দেরিতে অর্থাৎ ৫৫ বছরের পরে মেনোপজ হওয়া, পরিবারে ব্রেস্ট ক্যানসারের ইতিহাস থাকা। আর মডিফায়েবল কারণগুলো হলো স্থূলতা বা মোটা হওয়া, হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নেওয়া, দেরিতে অর্থাৎ ৩০ বছর পর সন্তান নেওয়া বা সন্তান না নেওয়া, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, অ্যালকোহল গ্রহণ এবং উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া। এগুলো এড়িয়ে চললে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।’
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়া এসকেএফ অনকোলজির সারা দেশে রয়েছে ৩৩টি সেবাকেন্দ্র, যার মাধ্যমে ক্যানসারের ওষুধ পাওয়া যায়। শুধু তা–ই নয়, ঘরে বসে অর্ডার করলেই বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে সহজেই পৌঁছে দেওয়া হয়।
নন-মডিফায়েবল রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে জিনগত ফ্যাক্টর কীভাবে ভূমিকা রাখে? সে ক্ষেত্রে স্ক্রিনিং কখন থেকে শুরু করা উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, স্ক্রিনিং আসলে করা হয় স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য, যাদের এখনো ক্যানসার হয়নি—যেন প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করা যায়। স্ক্রিনিংয়ের কিছু ধাপ রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন, এটি মাসিক শেষ হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পর প্রতি মাসে নিজে নিজে ব্রেস্ট পরীক্ষা করা উচিত। তিন আঙুলের সাহায্যে ব্রেস্ট ও বগল ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা উচিত কোনো গোটা বা স্রাব আছে কি না। আরেকটি হলো, স্ক্রিনিং মেমোগ্রাম। তিনি বলেন, মেমোগ্রাম ৪০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিবছর করা উচিত। যদি কারও পরিবারে ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, যেমন মা বা বোনের ব্রেস্ট বা ওভারি ক্যানসার ছিল—তাহলে স্ক্রিনিং আরও আগে থেকে শুরু করা উচিত। আর হাই–রিস্ক গ্রুপের জন্য ‘এমআরআই’ করা যেতে পারে। এই স্ক্রিনিং প্রক্রিয়াগুলো ক্যানসারকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে সহায়তা করে।
স্টেজিংয়ের গুরুত্ব এবং চিকিৎসা নির্ধারণে এর ভূমিকা সম্পর্কে ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেকোনো ক্যানসারের ক্ষেত্রে স্টেজিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্টেজ জানলে আমরা ঠিক করতে পারি রোগীকে কোন চিকিৎসা দিতে হবে এবং তার প্রগনোসিস কী হতে পারে।’
নাহিদ হোসেন বলেন, ব্রেস্ট ক্যানসারের চারটি স্টেজ—স্টেজ–১ ও ২, যখন সাধারণত অপারেশন করা হয়। তারপর কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা হরমোন থেরাপি দেওয়া হয়। স্টেজ–৩—আগে কেমোথেরাপি দিয়ে টিউমার ছোট করে তারপর সার্জারি। আর স্টেজ–৪–এ ক্যানসার শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; তখন কিউরেটিভ সার্জারির সুযোগ থাকে না। তখন কেমোথেরাপি, হরমোনোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা ইমিউনোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এ ছাড়া চিকিৎসা শুরু করার আগে দুটি পরীক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ—স্টেজিং রিপোর্ট এবং হরমোন রিসেপ্টর স্ট্যাটাস। এই ফলাফলের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা সার্জারি পাবে।
কেমোথেরাপি আসলে ক্যানসার সেলগুলোকে কীভাবে টার্গেট করে? সব স্তন ক্যানসার রোগীর জন্য কি কেমোথেরাপি দরকার? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, ক্যানসারের চিকিৎসা বহুমুখী—সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, টার্গেট থেরাপি। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানে কেমোথেরাপিকে বলা হয় ‘সাইটোটক্সিক ড্রাগ থেরাপি’, যার কাজ হলো দ্রুত বিভাজনশীল কোষ, যেমন ক্যানসার সেলগুলোকে ধ্বংস করা। তবে সব রোগীর জন্য কেমোথেরাপি প্রয়োজন হয় না। এটি নির্ভর করে ক্যানসারের স্টেজ, রোগীর হরমোন রিসেপ্টর স্ট্যাটাস এবং সাধারণ শারীরিক অবস্থার ওপর। সুতরাং সঠিক স্টেজিং ও নির্ভুল ডায়াগনোসিস ছাড়া চিকিৎসা শুরু করা উচিত নয়।