মৌলভীবাজার জেলার জুড়ীর এক চা-বাগানে ফুটেছে মেডলা (বাঁয়ে)। আরেক বাগানে শোভা ছড়িয়েছে অরল
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ীর এক চা-বাগানে ফুটেছে মেডলা (বাঁয়ে)। আরেক বাগানে শোভা ছড়িয়েছে অরল

প্রকৃতি

অরল-মেডলায় বর্ণিল হেমন্ত

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় আবার গেলাম তিন বছর পর। যাওয়ার কথা যত সহজে বলা গেল, যাওয়াটা তত সহজ ছিল না। ইদানীং সিলেটের ট্রেনের টিকিট রীতিমতো সোনার হরিণ! আর সড়কপথে যাত্রা মানে তো প্রায় নরক ভ্রমণ করে আসার মতো। বারবার তারিখ পিছিয়ে ট্রেনের টিকিট জোগাড় করা গেল।

কুলাউড়া স্টেশনে নেমে জুড়ীর একটি চা-বাগানে পৌঁছাতে প্রায় মধ্যরাত। বাগানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ মোদাব্বীর হোসেন স্বাগত জানালেন। তাঁর সঙ্গে গল্প–আড্ডায় খাওয়ার পর্ব শেষ হলো। রাতে থাকার বন্দোবস্ত সেখানেই। বাংলোর আরামদায়ক বিছানায় ঘুমিয়ে যেতে যেতে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেলাম। কার্তিকের হিম বৃষ্টি। এই বৃষ্টি না থামলে সকালে বাইরে যাওয়া অনিশ্চিত। সকালে অসংখ্য পাখির সুরেলা সংগীতে ঘুম ভাঙল। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু মেঘলা সকালে ভেজা বাতাসের আমেজ ছড়িয়ে ছিল।

বেলা একটু গড়াতেই এলেন সাংবাদিক কল্যাণ প্রসূন। তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। চা-বাগানের ভেতর সরু পথ ধরে ছুটছে আমাদের বাইক। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। বাগানের কর্মীরা নানান কর্মযজ্ঞে ছড়িয়ে পড়েছেন। পাতা তুলে টংঘরে নিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। গাঢ় সবুজের বুক চিরে যেতে যেতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল ভিন্ন কোনো রঙে। সাদা আর সোনালি-হলুদ ফুলের এক টুকরা স্বর্গোদ্যান যেন! সাদা ফুলটি খুবই চেনা—মেডলা; হলুদ ফুলটি স্থানীয়ভাবে অরল বা উড়ি (শিম) ফুল নামে পরিচিত।

গুল্ম শ্রেণির এই দুই উদ্ভিদ মূলত বাগানে চা-গাছের ছায়া উদ্ভিদ হিসেবে কাজে লাগে। এ জন্য রীতিমতো বীজতলায় চারা তৈরি করে এসব গাছ বাগানে রোপণ করা হয়। মেডলা ও উড়ি ফুলের গড়ন অনেকটা একই রকম হলেও বর্ণগত বৈসাদৃশ্য এদের আলাদা করেছে। তবে দুটি উদ্ভিদই ফ্যাবাসি পরিবারের সদস্য। চা-বাগানের বাইরে মেডলা দেখেছি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। হেমন্ত থেকে শীতের প্রথম ভাগজুড়ে এদের প্রস্ফুটন প্রাচুর্য উপভোগ করা যায়।

 মেডলা

মেডলা

মেডলা (Tephrosia candida) সিলেটে আঞ্চলিকভাবে মেদলা বা বগুই নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও বাঙ্গারা নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম White Hoarypea, White Tephrosia। আদি আবাস ভারত, ভুটান এবং হিমালয়ের পাদদেশের উপ-উষ্ণ অঞ্চলের অনুচ্চ পাহাড়। ইদানীং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চা-বাগানগুলোতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। গুল্ম শ্রেণির এই গাছ আড়াই থেকে সাড়ে তিন মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ডালপালা কিছুটা ছড়ানো বা বিক্ষিপ্ত ধরনের। পাতা বিপ্রতীপভাবে বিন্যস্ত, তবে ততটা ঘনবদ্ধ নয়; যা ৫ থেকে ১১ মিলিমিটার লম্বা, কোমল, গাঢ় সবুজ, কিনারা সরু রুপালি রেখায় চিত্রিত। দুধ-সাদা রঙের মুক্ত পাপড়ির ফুলগুলো ৫ থেকে ১৩ মিলিমিটার দীর্ঘ, বাইরের আবরণ ধূসর বাদামি রোমে আবৃত। বৃত্তাংশ ঘণ্টাকৃতির, ১৩ থেকে ১৫ মিলিমিটার দীর্ঘ, ফোটে পর্যায়ক্রমে। ফুল শেষ হতে না হতেই আসে ফল। ফল শিমগোত্রীয়, চ্যাপটা, ৭ থেকে ১২ সেন্টিমিটার লম্বা, তলোয়ারসদৃশ এবং বীজ প্রায় ২০টি। পরিপক্ব ফল আপনাআপনিই ফেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

গাছের পাতা উৎকৃষ্ট পশুখাদ্য, শুকনা পাতা পোকামাকড় দমনে কার্যকর এবং পুরোনো গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার্য।

অরল ফুল

অরল ফুল

সোনালি-হলুদ রঙের অরল ফুলের গাছ (Crotalaria micans) সাধারণত সাড়ে ৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। স্বভাবের দিক থেকে মাঝারি আকৃতির গুল্ম। ইংরেজি নাম Shining Rattlepod। অপরিণত শাখা–প্রশাখা কোনাকার। পাতা ত্রিপত্রিক, পত্রক আয়তাকার থেকে বল্লমাকার, ওপরের পিঠ রোমহীন, নিচের পিঠ রোমশ, শীর্ষ সূক্ষ্মাগ্র থেকে দীর্ঘাগ্র। পুষ্পবিন্যাস রেসিম, কিছুটা ঘন, ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং কিছুটা পাতা-প্রতিমুখ। পুষ্পবৃন্ত প্রায় ৮ মিলিমিটার লম্বা, মঞ্জরিপত্র সূত্রাকার, ৫ থেকে ৬ মিলিমিটার লম্বা, খুবই প্রারম্ভিক আশুপাতী। বৃতি প্রায় ১০ মিলিমিটার লম্বা, নল ঘণ্টাকার, দাঁতের মতো অর্ধসমান, ত্রিকোণাকার, দীর্ঘাগ্র। দলমণ্ডল হলুদ, ফলক অর্ধবৃত্তাকার, দণ্ড প্রায় ৫ মিলিমিটার লম্বা। গর্ভাশয় রোমশ, বৃন্ত প্রায় ২ মিলিমিটার লম্বা। ফল শিমের মতো, আংশিক বৃন্তক এবং আয়তাকার। হৃৎপিণ্ডের মতো। ফুল ও ফলের মৌসুম অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত।

এ গাছ উন্মুক্ত তৃণভূমি ও পাহাড়ি বনাঞ্চলে জন্মে। দক্ষিণ আমেরিকায় কোথাও কোথাও শোভাবর্ধক এবং ঔষধি উদ্ভিদ হিসেবে চাষ করা হয়। চট্টগ্রাম, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় পাওয়া যায়।

  • মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক