শিয়াল মারার বৈদ্যুতিক ফাঁদ
শিয়াল মারার বৈদ্যুতিক ফাঁদ

শিয়াল মারতে ফাঁদ, মানুষও মরছে

সদ্য প্রয়াত বিজ্ঞানী রেজাউর রহমানের একাত্তরের বয়ান নেওয়ার সময় বারবার কাপাসিয়া প্রসঙ্গ আসে। একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস বইয়ের কাজের সময় তাঁর সঙ্গে কথা হয়। একাত্তরে পুরান ঢাকার বংশালের ছেলে রেজাউর রহমান নিজ দেশে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার গ্রামে; সঙ্গে ছয় বোন। ঢাকা থেকে পরিবার–পরিজনের জন্য সাপ্তাহিক রেশন (চাল, ডাল, তেল, সাবান, সোডা, চা, চিনি ও লবণ) নিয়ে ফিরতে হতো তাঁকে। এক আশ্রয় থেকে তাড়া খেয়ে আরেক আশ্রয়ে ছুটতে হতো। তিনি বলেছিলেন, সেটা যেন বন্য প্রাণীর জীবন ছিল।

গত ১২ অক্টোবরের কথা। কাপাসিয়ার দস্যু নারায়ণপুরের চায়ের দোকানে দেখি স্থানীয় কলা আর ড্রাগন ফল সাজানো। দোকানে বসে স্থানীয় হালহকিকত নিয়ে আলাপ করতে করতে নোট বই খুলতেই দেখি, রেজাউর রহমানের ‘বন্য প্রাণী’ উদ্ধৃতির পাতাটা বারবার চলে আসছে। দোকানের মালিক সামশুল ভাইকে বললাম, ‘এদিকে শিয়াল, বানর, ময়ূর কি এখনো আছে?’

সামশুল বলেন, ‘ড্রাগনও খাবেন আবার শিয়ালও চাইবেন, তা কেমনে হয়? ড্রাগনখেতে শিয়ালের বড় অত্যাচার। মানুষ কারেন্টের (বৈদ্যুতিক) ফাঁদ দিয়ে দেদার শিয়াল মারছে। অন্য প্রাণীও মরে। কেউ বানারে (শীতলক্ষ্যার স্থানীয় নাম) ফ্যালায়, কেউ গর্ত করে পুঁতে দেয়।’

খামারিরা চোর ও শিয়াল ঠেকাতে ড্রাগন বাগানের চারপাশে জিআই তারের বেড়ায় বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়ে রাখছেন। সেই তারে জড়িয়ে মারা যাচ্ছে শিয়াল, খাটাশ, ভাম (বিড়ালের মতো দেখতে), বনবিড়াল, গন্ধগোকুল ইত্যাদি।

দোকানের শিশুশ্রমিক সালাম যোগ না দিয়ে পারে না। বলে, ‘নাহ্‌, সবগুলি পোঁতে না; ঢাকায় চালান করে।’ সালামের রসবোধ আমাকে চমকে দেয়। শিশুদের জন্য নাকি বানানো হয়েছে ভিডিও কার্টুন, শিয়াল ও ড্রাগন ফ্রুট।

খামারিরা চোর ও শিয়াল ঠেকাতে ড্রাগন বাগানের চারপাশে জিআই তারের বেড়ায় বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়ে রাখছেন। সেই তারে জড়িয়ে মারা যাচ্ছে শিয়াল, খাটাশ, ভাম (বিড়ালের মতো দেখতে), বনবিড়াল, গন্ধগোকুল ইত্যাদি। সালাম বলতে থাকেন, ‘মানুষ মরলে খবর হয় দাদু; হিয়াল, কুত্তা, বানর মরলে খবর হয় বড়?’ (খবর হয় না!!) বানরও মরে নাকি? সালামের জবাব, ‘না, হেরা আন্ধারেতে বাহির হয় না।’ বুঝলাম সালাম এই বয়সে বন্য প্রাণীদের আচার-আচরণ জানে।

জিআই তারের বেড়ায় বিদ্যুৎ–সংযোগের ফাঁদ এখন প্রায় সারা দেশের চর্চা। শিয়াল মারতে মানুষ মারার খবর আসছে। মানুষের প্রাণহানি নিয়ে আমরা যেমন বিচলিত হই, বন্য প্রাণীর এ রকম বেধড়ক হত্যা আমাদের বিচলিত করে কি? যদিও বন্য প্রাণী আইনে শিয়াল মারা দণ্ডনীয় অপরাধ।

আগে শিয়াল দেখলেই কুকুর তাকে তাড়া দিয়ে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিত। এখন খামারির কুকুর শিয়ালের ভয়ে গুটিসুটি মেরে সটকে পড়ছে। প্রকৃতির চিরায়ত ভারসাম্য কে নষ্ট করল? গোরস্থান, শ্মশান আর ঝোপঝাড়ের গর্তে লুকিয়ে থাকা শিয়াল এখন কোন সাহসে লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ভয়ার্ত কুকুরকে চ্যালেঞ্জ করে?

২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন–এর ৩৫ নম্বর ধারায় জামিন না দেওয়ার কথা বলা আছে। শক্ত আইন, মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ (মব ভায়োলেন্সের ঝুঁকি সত্ত্বেও) এসবই খুব জরুরি বিষয়। কিন্তু এসবের পাশাপাশি ভাবতে হবে শিয়াল কেন এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। আগে শিয়াল দেখলেই কুকুর তাকে তাড়া দিয়ে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিত। এখন খামারির কুকুর শিয়ালের ভয়ে গুটিসুটি মেরে সটকে পড়ছে। প্রকৃতির চিরায়ত ভারসাম্য কে নষ্ট করল? গোরস্থান, শ্মশান আর ঝোপঝাড়ের গর্তে লুকিয়ে থাকা শিয়াল এখন কোন সাহসে লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ভয়ার্ত কুকুরকে চ্যালেঞ্জ করে?

পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণ। একসময় পৌর এলাকায় কারফিউ দিয়ে গুলি করে কুকুর মারত পুলিশ, তারপর শুরু হয় সাঁড়াশি দিয়ে ধরে ইনজেকশনে মারা। এখনো এটা কমবেশি চালু আছে। ফলে বেওয়ারিশ কুকুর একেবারেই কোণঠাসা। বেপরোয়া মোটরসাইকেলচালকদের চাকায় হরদম পিষ্ট হচ্ছে কুকুরশাবক। গত বছর ধানমন্ডির এক রাস্তায় স্থানীয় কিশোর-কিশোরীদের অনেক চেষ্টার পরেও একে একে সাতটি নবজাতক কুকুর গাড়ি/বাইকের চাপায় নিহত হয়।

গবেষকেরা বলছেন, কুকুরদের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে তাদের পছন্দের আবাসস্থল শিয়ালদের জন্য বেশি উপযুক্ত হয়ে ওঠে। জলাতঙ্ক আতঙ্ক দূর করার জন্য কুকুর নিধন বাস্তবে এই প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এটি অকার্যকর ও অমানবিক সমাধান। এটি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা বাড়ে।

পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণ। একসময় পৌর এলাকায় কারফিউ দিয়ে গুলি করে কুকুর মারত পুলিশ, তারপর শুরু হয় সাঁড়াশি দিয়ে ধরে ইনজেকশনে মারা। এখনো এটা কমবেশি চালু আছে। ফলে বেওয়ারিশ কুকুর একেবারেই কোণঠাসা। বেপরোয়া মোটরসাইকেলচালকদের চাকায় হরদম পিষ্ট হচ্ছে কুকুরশাবক।

সালাম তার সংগ্রহে থাকা পেপার কাটিং দেখিয়ে বলে শিয়ালের খুব বুদ্ধি, পোষ মানে, কথা শুনে। তার দুটো শিয়াল আছে। তার সংগ্রহে দেখি, ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোর কুষ্টিয়া প্রতিনিধি তৌহিদী হাসানের এক সচিত্র প্রতিবেদন ‘ভালোবাসায় পোষ মেনেছে শিয়ালের দল’। আমি এই শিশুকে বন্য প্রাণী প্রেমিক বলব না গবেষক বলব? আমি টাস্কি খাচ্ছি পদে পদে। বলে, কারেন্টের ফাঁদে শিয়াল মারা বন্ধ না করলে এদের আর রক্ষা করা যাবে না।

বন্য প্রাণী কার পরজ্জা (প্রজা মানে কোন মন্ত্রণালয়ের)? সালামের এই প্রশ্ন শুনে তাকে আর শিশু ভাবতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল একজন অ্যাকটিভিস্ট। বন্য প্রাণীর দায়িত্ব বন মন্ত্রণালয়ের। তারা প্রাণিসম্পদের হিস্যা হবে না কেন?

বন্য প্রাণী সুরক্ষায় প্রণীত ২০১২ সালের আইনে প্রতিবছর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের কথা। এত দিনে কমপক্ষে ১২টি প্রতিবেদন থাকার কথা! থাকলে ফি বছর বন্য প্রাণীর উন্নতি/অবনতির হালহকিকত জানা যেত। বিআইডিএস বা টিআইবি অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষক (দলকানা নয় এমন) দিয়ে কাজটা করা যায়। অন্তর্বর্তীরা অন্তর থেকে চাইলে এটুকু কাজ খুবই সম্ভব।

বন্য প্রাণী কার পরজ্জা (প্রজা মানে কোন মন্ত্রণালয়ের)? সালামের এই প্রশ্ন শুনে তাকে আর শিশু ভাবতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল একজন অ্যাকটিভিস্ট। বন্য প্রাণীর দায়িত্ব বন মন্ত্রণালয়ের। তারা প্রাণিসম্পদের হিস্যা হবে না কেন?

‘কারেন্ট’ দিয়ে শিয়াল মারার কৌশল/বুদ্ধি খামারিদের কাছে কীভাবে এল? ফেসবুক-ইউটিউবে সব আছে। সেখানে খোলাখুলি সব বর্ণনাসহ বিকল্প বিষটোপের নানা হিসাব-নিকাশ দেওয়া আছে। বন্য প্রাণী রক্ষা আইনে এ দিকটা একেবারেই অনুচ্চারিত আছে। সালামের কাছে জানলাম ফাঁদে আটকিয়ে সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই শত শত শিয়ালের সঙ্গে মানুষও মারা যাচ্ছে। এদের অনেকই মানসিক প্রতিবন্ধী, শিশু, বেড়ার পাশে গজিয়ে ওঠা ঘাস বা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা শাক তুলতে যাওয়া নিতান্তই গরিব প্রবীণ বিধবা।

প্রায় সব ধর্মেই প্রাণীদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে বলা হয়েছে। প্রাণীদের খাবার দেওয়া এবং আশ্রয় দেওয়াকে সওয়াবের কাজ হিসেবে দেখা হয়। একই সঙ্গে বিনোদনের জন্য প্রাণী হত্যা বা নিষ্ঠুর আচরণ, যেমন জীবন্ত প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের আরও হেদায়েতের প্রয়োজন।

গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার তালসার গ্রামে মারা যায় একটি গরু। তাকে বাঁচাতে এসে একজন মারা যান। আহত হন আরেকজন।

গত ১৪ জুন ২০২৫, রাজশাহীর বাগমারায় মানসিক প্রতিবন্ধী আবদুল মমিনের লাশ উদ্ধার হয় ফাঁদ থেকে। মুক্তাগাছায় মারা যান ছাত্রী মর্জিনা। মানুষের মরণ হলে গ্রামে অনেক কাইজা হয়, পুলিশ আসে। প্রাণীদের উকিল মোক্তার পুলিশ নাই!!

ধানমন্ডির কাহিনি বুকের চাপটা বাড়িয়ে দেয়। সেখানে চারটি বিড়ালের চোখ উপড়ে নিয়েছে কেউ। অনাচার!! প্রাণীর কষ্টে আনন্দ পাচ্ছে কেউ কি? কয়েক বছর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা কুকুর–বিড়াল হত্যায় মেতে উঠেছিলেন। সেবার প্রাণীদের পক্ষে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে হত্যা বন্ধ হয়।

প্রায় সব ধর্মেই প্রাণীদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে বলা হয়েছে। প্রাণীদের খাবার দেওয়া এবং আশ্রয় দেওয়াকে সওয়াবের কাজ হিসেবে দেখা হয়। একই সঙ্গে বিনোদনের জন্য প্রাণী হত্যা বা নিষ্ঠুর আচরণ, যেমন জীবন্ত প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের আরও হেদায়েতের প্রয়োজন।

  • গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক wahragawher@gmail.com