দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার জোতমাধব গ্রামের গিলাগাছ
দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার জোতমাধব গ্রামের গিলাগাছ

প্রকৃতি

বিপুল সৌন্দর্যের গিলালতা

শালবনসংলগ্ন বাড়ির আঙিনায় উৎসুক নারী-পুরুষের ভিড়। মাটি থেকে বেরিয়েছে প্যাঁচানো চারটি মোটা লতা। একটির সঙ্গে আরেকটি পেঁচিয়ে ওপরে উঠে আশপাশের শালগাছের চূড়ায় মিশেছে। দূর থেকে মনে হবে এটি নীলাকাশে ওঠার সর্পিলাকার সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে খেলছে গ্রামের দুরন্ত শিশুরা। সিঁড়িতে বসে ছবি তুলছেন দর্শনার্থীরা।

এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার ৬ নম্বর জোতবানী ইউনিয়নের জোতমাধব গ্রামের শালবনে। ১১ বছর বয়সী চারটি গিলাগাছের দৃষ্টিনন্দন লতা ও ফলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন সেখানে ভিড় করছেন উৎসুক দর্শনার্থী। বিলুপ্তপ্রায় এমন গাছের খবর এখন উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে আশপাশের জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুজহাত তাসনীম, বন বিভাগের কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা গিলাগাছটি পরিদর্শন করেছেন।

দূরদূরান্ত থেকে আসা উৎসুক দর্শনার্থীদের কৌতূহলী প্রশ্নে অনেকটা বিপাকেই পড়েছেন গিলাগাছের মালিক জালাল উদ্দীন (৬২)। কেউ জানতে চাইছেন গাছের জন্ম–ইতিহাস, বয়স, ফল ধরার সময় ও গিলা ফলের উপকারিতা। সহজ–সরল মনে দর্শনার্থীদের সেই কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছেন জালাল উদ্দীন। তবে দর্শনার্থীরা গাছে ওঠায় লতাপাতা ও ফল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।

জালাল উদ্দীন ২৫ বছর ধরে স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি পেশায় একজন নলকূপ মিস্ত্রি। তিনি ১১ বছর আগে রংপুরে বেড়াতে গিয়ে রান্নার জন্য কয়েকটি গিলাবীজ আনেন। পরে স্ত্রী তহমিনা খাতুনকে ওই গিলাবীজগুলো রান্না করতে দেন। তহমিনা খাতুন গিলাবীজ থেকে চারটি বীজ বাছাই করে বাড়ির আঙিনায় বপন করেন। তিন বছর পর বীজ থেকে চারটি চারা জন্মে। গিলাবীজ বপনের আট বছর পর গাছে গিলা ধরে বলে জানান জালাল উদ্দীন। গাছে ফুল ও ফল ধরা দেখে জানতে পারেন চারটি গাছের মধ্যে একটি স্ত্রী গাছ আর অপর তিনটি পুরুষ গাছ। এ গাছ থেকে প্রতিবছর ১০০ থেকে ১৫০টি গিলাবীজ সংগ্রহ করেন তিনি।

জালাল উদ্দীনের বাড়ির আঙিনায়

মাটির ওপরে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১০ হাত ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১৫ হাত অংশজুড়ে চারটি গিলাগাছের শিকড় ও লতা পেঁচিয়ে রয়েছে। কোনো কোনো গিলালতা ওপর থেকে মাটিতে মিশে আবার শিকড়ে পরিণত হয়েছে। গিলালতায় বাতাসে ঝুলছে বৃহদাকৃতির সবুজ গিলা ফল।

উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্যমতে, গিলাগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Entada phaseoloides। এটি মজবুত কাণ্ডের লতাজাতীয় চিরসবুজ উদ্ভিদ। এই গাছ কমপক্ষে ১৪০ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। এই গাছের পাতা যৌগিক। প্রতিটি পত্রফলকে ২ থেকে ৮টি পত্রক থাকে। গাছটির লতাসদৃশ কাণ্ড মোটা, আঁকাবাঁকা ও অনেকটা বিক্ষিপ্ত এবং বেশ শক্তপোক্ত। গাছের পুষ্পমঞ্জরি ১২ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। মে মাসের দিকে গিলালতায় সরু ও সাদা পাপড়িসমৃদ্ধ ফুলগুলো ফোটে। আর অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ফলগুলো পরিপক্ব হয়ে ওঠে। প্রতিটি ফলে ১০-১৫টি করে বীজ থাকে। গিলাবীজ গাঢ় লালচে বর্ণের। এটি চ্যাপটা, গোলাকার ও শক্ত।

জোতমাধব গ্রামের গৃহিণী রিজিনা পারভীন বলেন, মাংস রান্নায় তিনি গিলা ফল ব্যবহার করে থাকেন। এতে শরীরে ব্যথা কমে।

গিলাগাছের মালিক জালাল উদ্দীনের ভাষ্য, এই গাছ সংরক্ষণের জন্য সরকারকে বা বন বিভাগের কাছে অনুরোধ করছি। চারটি গাছের মধ্যে একটি থেকে ফল হয়। এক হালি বীজ ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। বছরে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার গিলাবীজ বিক্রি করেন তিনি।

বিলুপ্তপ্রায় এ গাছের বিষয়ে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গিলালতা শিম পরিবারের সবচেয়ে বড় ফলের গাছ। এটি মূলত পাহাড়ি অঞ্চল ও শালবনে জন্মে। গাছটির পাতা, কাণ্ড, ছাল ও বীজে অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে। গিলালতা বাংলাদেশে একটি বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ। একমাত্র জনসচেতনতা ও সরকারি উদ্যোগে গবেষণার মাধ্যমে এ গাছের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব।’