১৫ মার্চ ২০১৪। ভোর থেকে সুন্দরবনের কটকার জামতলা খালে সুন্দরী হাঁস খুঁজতে খুঁজতে বেশ ক্লান্ত। সকাল ১০টা নাগাদ কটকা বিট অফিসের সামনে নোঙর করা ছোট্ট লঞ্চ ‘রাজকন্যা’য় এসে পৌঁছলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। ডিমভাজা দিয়ে ভুনা খিচুড়ি খেলাম ভরপেট। এরপর খানিকটা বিশ্রাম। তারপর লঞ্চে বাঁধা কোষা নৌকা নিয়ে কটকা খালপাড় ধরে পাখি-প্রাণী খুঁজতে থাকলাম।
খালপাড়ে বানর ও হরিণের সহাবস্থান ভালো লাগল। কেওড়াগাছের ডালে বসা সিতকণ্ঠী ও মাথাকালো মাছরাঙার ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎই ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে কাস্তের মতো বাঁকানো ও লম্বা ঠোঁটের একটি পাখিকে শূলাময় (শ্বাসমূল) কাদা পাড়ে হাঁটতে দেখলাম। ৭ ডিসেম্বর ২০১০-এর পড়ন্ত বিকেলে একই প্রজাতির ২০ থেকে ২৫টি পাখির একটি ঝাঁককে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখেছিলাম। ওটাই ছিল প্রথমবারের মতো এই পাখি দেখা। দুপুর ১২টা ৭ মিনিট ১৫ সেকেন্ড থেকে ১২টা ৮ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড পর্যন্ত ছবি তোলার সুযোগ দিয়ে পাখিটি উড়াল দিল।
ঠিক ছয় মিনিট পর লম্বা ও বাঁকানো ঠোঁটের আরেকটি পাখি শূলাময় কাদায় নামল। দ্রুত ওর কিছু ছবি তুলে রিভিউ করতেই মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আরে, এর ঠোঁট তো আরও লম্বা ও বাঁকানো; আকারেও কিছুটা বড়! বহুদিন ধরে ওকে খুঁজছি! মনের আনন্দে ওর প্রতিটি পদক্ষেপের ছবি তুললাম। বেশ সময় দিল ও। শেষটায় দিল অতি সুন্দর এক উড়ন্ত ছবি। ৮ জানুয়ারি ২০১৬-এ দমার চরে এই প্রজাতির পাখির বেশ কটি ঝাঁক দেখেছিলাম। একই বছর চট্টগ্রামের ফইল্লাতলী সৈকতে একসঙ্গে ছোট ও বড় দুই প্রজাতিই দেখেছিলাম। এর পর থেকে ওদেরকে নিয়মিত দেখছি কক্সবাজারের সোনাদিয়া ও সুন্দরবনে কটকা ও কচিখালিতে।
এতক্ষণ যে দুই প্রজাতির পাখির গল্প বললাম, ওরা স্কোলোপ্যাসিডি বা আরামুখ গোত্রভুক্ত নিচ দিকে বাঁকানো ঠোঁটের পাখি গুলিন্দা। এই গোত্রের বেশির ভাগ পাখির ঠোঁটই সোজা ও লম্বা। তবে কিছু প্রজাতির ঠোঁট ওপর বা নিচ দিকে বাঁকানো। এরা প্রধানত স্বাদুপানির জলাভূমি ও উপকূলীয় এলাকায় বিচরণ করে। বিশ্বব্যাপী আট প্রজাতির গুলিন্দার অস্তিত্ব থাকলেও এস্কিমো ও সরুঠোঁটি গুলিন্দা সম্ভবত হারিয়ে গেছে। বাকি ছয়টির মধ্যে শীতে পরিযায়ী হয়ে দুটি প্রজাতি নিয়মিত ও একটি অনিয়মিতভাবে এ দেশে আসে। এখানে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো।
১. ছোট গুলিন্দা (Whimbrel): কটকা খালপাড়ে দেখা প্রথম পাখিটি ছোট গুলিন্দা। রাম চ্যাগা, কাঁচি চ্যাগা, কোদাইল্লা বা সরলা বাটান (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Numenius phaeopus । মূল আবাস আইসল্যান্ড, স্কটল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের দৈর্ঘ্য ৩৭ থেকে ৪৭ সেন্টিমিটার, ওজন ২৭০ থেকে ৪৯৩ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও আকারে স্ত্রী কিছুটা বড়। মূলত চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের কাদাচর, নদীর পাশের আবদ্ধ পানি, বাদা বন ও উপকূলীয় এলাকায় একাকী বা ছোট থেকে মাঝারি দলে বিচরণ করে।
২. বড় গুলিন্দা (Eurasian/Common Curlew) কটকা খালপাড়ে দেখা দ্বিতীয় পাখিটি বড় গুলিন্দা। ছোটটির মতো এটিও রাম চ্যাগা, কাঁচি চ্যাগা ও কোদাইল্লা নামে পরিচিত। এ ছাড়া সাদাচোরা, সাদা কাঁচিচোরা বা রণ-পা পাখিও বলে। পশ্চিমবঙ্গে বলে চোপ্পা বা সাদা কাষ্ঠচূড়া। বৈজ্ঞানিক নাম Numenius arquata। মূল আবাসস্থল ইউরোপের ব্রিটিশ আইল্যান্ড থেকে সাইবেরিয়া। দেহের দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার, ওজন ৪০০ থেকে ১৩৬০ গ্রাম। স্ত্রী আকারে বড়।
৩. বৃহত্তম গুলিন্দা (Far Eastern Curlew): পাখিটির কথা শুধু বইয়েই পড়েছি, স্বচক্ষে দেখিনি। এটি এ দেশের বিরল পরিযায়ী ও বিশ্বব্যাপী বিপন্ন পাখি। বৈজ্ঞানিক নাম Numenius madagascariensis। পূর্ব রাশিয়া ও উত্তর–পূর্ব মঙ্গোলিয়ার আবাসিক পাখিটি শীতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া ও চীনে পরিযায়ন করে। এটিকে শীতে একবার কক্সবাজারে দেখা গিয়েছিল।
প্রজাতিভেদে এদের প্রজননকাল এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে এরা পরিযায়ী পাখি হওয়ায় এ দেশে ডিম-ছানা তোলে না। আয়ুষ্কাল ১১ থেক ১২ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়