অর্কিড কাঞ্চন
অর্কিড কাঞ্চন

কোনটি কোন কাঞ্চন

ইদানীং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাঞ্চন ফুল নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য চোখে পড়েছে। বিভ্রান্তিকর এই তথ্যে ফুলগুলো ক্রমে ভুল নামে পরিচিত হয়ে উঠছে। হয়তো এমন একটা সময় আসবে, যখন ভুল নামকে শুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যও কেউ কেউ সোচ্চার হবেন। মূলত বিভ্রান্তি দূর করে কাঞ্চনের সঠিক পরিচিতি তুলে ধরাই এ লেখার উদ্দেশ্য। আমাদের দেশে প্রধানত তিন ধরনের কাঞ্চন বেশি চোখে পড়ে—রক্তকাঞ্চন, দেবকাঞ্চন ও শ্বেতকাঞ্চন। এর মধ্যে সবচেয়ে সহজলভ্য রক্তকাঞ্চন। শীতের শেষে পত্রহীন এ গাছে অসংখ্য ফুল ফোটে। প্রধান প্রস্ফুটন মৌসুম বসন্ত। দেবকাঞ্চন ফোটে হেমন্তে। তবে দুর্লভ, সংখ্যায় খুবই কম। সাদা কাঞ্চন গুল্মশ্রেণির গাছ। প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ছোট পাতার একটি লাল কাঞ্চনও দেখেছি। উঁচু এই গাছে অক্টোবর মাসেও ফুল ছিল। তবে সংখ্যায় কম। মধুপুরের বনে দেখেছি লতাকাঞ্চন।

এ ছাড়া গত কয়েক দশকে স্বর্ণকাঞ্চন, অর্কিড কাঞ্চনসহ বেশ কিছু নতুন কাঞ্চন দেশে এসেছে। এর মধ্যে হংকং অর্কিড বা অর্কিড কাঞ্চন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মূলত শীতকালে দীর্ঘকালীন প্রস্ফুটন প্রাচুর্যের কারণে ফুলটি সবার পছন্দ। অনেকেই কাঞ্চনের আবাদিত এই নতুন প্রজাতির সঙ্গে দেবকাঞ্চনের পার্থক্য বুঝতে না পেরে ভুল করেন। আসলে সব কাঞ্চনেরই কাণ্ড ও পাতার গড়ন একই, পার্থক্য শুধু ফুলে। এ কারণে ফুল না ফুটলে এদের আলাদা করে চিহ্নিত করাও কঠিন। তবে অন্যান্য কাঞ্চনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে রক্তকাঞ্চনই সুদর্শন। সঠিক শনাক্তির প্রয়োজনে উল্লেখযোগ্য তিন প্রজাতির কাঞ্চনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এখানে আবশ্যক।

রক্তকাঞ্চন, লাল কাঞ্চন

রক্তকাঞ্চন

রক্তকাঞ্চন (Bauhinia variegata) ছোটখাটো ধরনের গাছ। তবে কখনো কখনো একটু দীর্ঘও হতে পারে। এদের কাণ্ড নিচু, শাখা-প্রশাখা অনেক এবং কিছুটা ছড়ানো ধরনের। সব কাঞ্চনের পাতা তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। দুটি পাতা জোড়া দিলে দেখতে যেমন, পাতার শেষ প্রান্ত অবিকল সে রকম। এ কারণেই কাঞ্চনের বৈজ্ঞানিক নামের প্রথম অংশ দুজন যমজ উদ্ভিদবিজ্ঞানীর নাম থেকে নেওয়া। রক্তকাঞ্চন শীতকালে সব পাতা ঝরিয়ে মৃত গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এ অবস্থাতেই গাছজুড়ে ফুলের মেলা বসে। ফুলের মৌসুম অনেক দীর্ঘ। মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে ফুল থাকে। ফুল ঘন ম্যাজেন্টা রঙের। পাপড়িসংখ্যা ৫, তার মধ্যে একটি পাপড়ি কিছুটা ব্যতিক্রম, গোড়ার দিকে বেগুনি রঙের একটি ফোঁটা আছে। ফুল অবশিষ্ট থাকতে থাকতেই শিমের মতো চ্যাপটা ফল ধরে। ফলগুলো একসময় শুকিয়ে গিয়ে আপনা–আপনিই ফেটে যায়। তখন বীজগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কাঞ্চনগাছের বাকল থেকে ট্যানিং, রং ও দড়ি তৈরি করা যায়। বীজ তেল সস্তা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গাছের শিকড় বিষাক্ত এবং সর্প দংশনের প্রতিষেধক।

দেবকাঞ্চন

দেবকাঞ্চন

দেবকাঞ্চন (Bauhinia purpurea) মাঝারি আকারের অর্ধচিরসবুজ গাছ, ৮ থেকে ১০ মিটার উঁচু, মাথা ছড়ানো। পাতা মাথার দিকে ২ ভাগে বিভক্ত। অসমান ও লম্বাটে ৫ পাপড়ির মুক্ত এই ফুল ৬ থেকে ৮ সেমি চওড়া, কয়েকটি একত্রে একটি ডাঁটায় থাকে, সুগন্ধি, প্রথমে বেগুনি, পরে রং বদলে প্রায় সাদা হয়ে ওঠে। হেমন্তে সারা গাছ ভরে ফুল ফোটে। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ প্রায় সারা দেশেই বিক্ষিপ্তভাবে দেখা যায়। ফল অন্যান্য কাঞ্চনের মতোই আপনা–আপনিই ফেটে যায়। ভারতের শুষ্ক অঞ্চলের অরণ্যভূমি এদের আদি আবাস।

অর্কিড কাঞ্চন, হংকং অর্কিড

অর্কিড কাঞ্চন (Bauhinia blakeane) আমাদের দেশে অভিযোজিত নতুন উদ্ভিদ। পত্রমোচি গাছ, উচ্চতা প্রায় ৮ মিটার, কাণ্ড নিচু, বহুশাখি, ওপর ছত্রাকৃতি, বাকল ধূসর, অমসৃণ। পাতা চওড়া, পুরু ও অসম্পূর্ণভাবে সজোড়। জোড়া দেওয়া পাতার মতো। ফুল বড়, ১২ সেমি চওড়া, লাল অথবা গোলাপি-বেগুনি। ডালের আগায় থোকায় থোকায় ফোটে। গন্ধহীন। অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অনেক দিন সতেজ থাকে। প্রস্ফুটনকাল নভেম্বর থেকে মার্চ অবধি। রোদ পছন্দ। হাঁপানি, ক্ষত এবং পেটের পীড়ায় গাছের নানা অংশ উপকারী।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি পরিবেশবিষয়ক লেখক