স্বয়ং কবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে যাকে বিরহী যক্ষের প্রিয়ার চোখের পাপড়িকে তুলনা করেছেন স্থলপদ্মের আধখোলা ও আধবোজা চোখের পাপড়ির সঙ্গে, সেই স্থলপদ্মের রূপের কথা আমি আর কী লিখব?
কবি কালিদাস তাঁর কুমারসম্ভব কাব্যেও স্থলপদ্মকে তুলনা করেছেন কিশোরী পার্বতীর পদযুগলের সঙ্গে। কী চমৎকার সেই বর্ণনার চিত্রকল্প! পার্বতীর দেহে নবযৌবন আসার পর তিনি যখন ধীরগতিতে মাটির ওপর পা ফেলে চলেন, তখন তাঁর পা দুটির রক্তিম আভা, আঙুল ও নখের দীপ্তি এমনই মোহনীয় শোভা সৃষ্টি করত, যা দেখে মনে হতো বিধাতা যেন ওই পা দুটোয় স্থলপদ্মের শোভা ঢেলে দিয়েছেন, সেই শোভা ও সৌন্দর্যের দীপ্তিতে চারদিকে সব তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ভাবছি, কবিদের কাজই হলো উপমার ফুল ফোটানো, উপমাই কাব্যের মা।
হেমন্তের এক সকালে নড়াইল রামকৃষ্ণ মিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে আমিও যেন স্থলপদ্মের সেরূপ শোভায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সরু পথের দুই পাশে, বাগানের চারপাশে শতাধিক স্থলপদ্মের গাছ ভরে ফুটে আছে হাজার স্থলপদ্ম। একসঙ্গে এত স্থলপদ্ম ফুলের শোভা আর কখনো আমি কোথাও দেখিনি। সে এক অপূর্ব স্থলপদ্ম কানন।
নামটা স্থলপদ্ম হলে ফুলটা আদৌ পদ্ম না, পদ্ম গোত্রের কোনো জ্ঞাতি ফুল না। পদ্ম ফুল ফোটে জলে, স্থলপদ্ম ফুল ফোটে ডাঙায়। পদ্মফুলের গাছ নরম জলজ বীরুৎ, স্থলপদ্মের গাছ কাষ্ঠল গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ। পদ্মফুল ফোটে দিনে, কুমুদ বা শালুক ফোটে রাতে। দুটি গাছই জল ছাড়া বাঁচে না। স্থলপদ্ম ফুল ফোটে দিনে, তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার রং বদলাতে থাকে। ফোটার সময় স্থলপদ্ম ফুলের রং থাকে দুধে আলতা মিষ্টি গোলাপি, ধীরে ধীরে তার রং দুপুরে হয় গাঢ় গোলাপি ও বেলা শেষে লালচে গোলাপি হয়ে ঘুম আসা তরুণীর চোখের পাতার মতো পাপড়িগুলো কুঁচকে যায়।
তবে ফুলটা ফোটে পদ্মের মতোই চারদিকে পাপড়ি ছড়িয়ে, রংটাও পদ্মফুলের মতো। পদ্মফুল ফোটে শরতে, স্থলপদ্ম ফুল ফোটে শরৎ-হেমন্তে। জবা ফুলের কোনো ফল হয় না, কিন্তু স্থলপদ্মের ফল ও বীজ দুটিই হয়। পদ্মেরও ফল ও বীজ হয়, বীজ থেকে পদ্মের চারা হয়।
এক বসন্তে স্থলপদ্মের দেখা পেয়েছিলাম বান্দরবানের স্বর্ণমন্দিরের পাশে। বছর চারেক আগে শীতকালে ফরিদপুরে ব্র্যাক সেন্টারের আঙিনায় একটা পুকুরপাড়ে কয়েকটা স্থলপদ্মগাছে ডালের আগায় শুকনো ফলের দেখা পেয়েছিলাম। ফল গোলাকার থেকে উপগোলাকার, মাথার দিকটা রোমশ, পাঁচটি প্রকোষ্ঠযুক্ত। ফল শুকিয়ে শেষে আপনা–আপনি ফেটে যায় ও বীজ ছড়িয়ে পড়ে। বীজের রং কালচে খয়েরি বা পিঙ্গল-কালো ও বৃক্কাকার। সেই ফল থেকে কয়েকটি বীজ নিয়ে এসে মাটিতে বুনে চারাও করেছিলাম। এর ডালে গুটিকলম করে বা বয়স্ক ডাল টুকরা করে কেটে মাটিতে পুঁতে দিলে তা থেকেও গাছ হয়।
পদ্মের মতো স্থলে ফোটা ফুল বলেই কি এর নাম রাখা হয়েছে স্থলপদ্ম? পদ্মের আরেক নাম শতদল। অর্থাৎ এ ফুলের পাপড়ি থাকে প্রায় ১০০টি। কিন্তু স্থলপদ্ম ফুলের অত পাপড়ি নেই, বরং পাপড়িগুলো ও ফুলের চেহারা দেখে রক্তজবা ফুলের মতো মনে হয়, যদিও রংটা রক্তজবা ফুলের মতো লাল নয়—গোলাপি।
সে জন্যই কিনা জানি না, একে গোত্রভুক্ত করা হয়েছে জবা ফুলের গোত্রে, গোত্রের নাম মালভেসি—ঢ্যাঁড়স ও চুকুরও এ গোত্রের গাছ। জবা ফুলগাছের পাতার সঙ্গে স্থলপদ্মগাছের পাতার কোনো মিল নেই বটে, কিন্তু ঢ্যাঁড়সগাছের পাতার সঙ্গে স্থলপদ্ম পাতার বেশ মিল রয়েছে। ঢ্যাঁড়সের পাতার মতো স্থলপদ্মের পাতাও করতলাকার ও পাতার কিনারা গভীরভাবে খাঁজকাটা। পাতা ঢ্যাঁড়সের মতো রোমশযুক্ত হলেও তার মতো খসখসে না, কোমল। স্থলপদ্মের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Hubuscus mutabilis।
চীন দেশ থেকে এ ফুল এখন পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ দেশের অনেক মন্দির প্রাঙ্গণে গাছটি দেখা যায়। পূজার ফুল হিসেবে হালকা সুগন্ধি এ ফুলের কদর রয়েছে। এ গাছের ফুল, পাতা ও শিকড় ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফুলের পাপড়ি কাজ করে রসবহ স্রোতে, আর মূলের ছাল কাজ করে মেয়েদের রজোঘটিত রোগে অর্থাৎ ঋতুদোষের চিকিৎসায়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক