
নেপালের কাঠমান্ডু নগরীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে অনির্ধারিত ছুটি পায় স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এই ছুটির কথা তাদের বার্ষিক দিনপঞ্জিতে লেখা থাকে না। আর সেই ছুটি মেলে বায়ুদূষণের কারণে।
কাঠমান্ডু ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের সহকারী অধ্যাপক ননি রাউত বলেন, ‘পাঁচ–ছয় বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। আন্তসীমান্ত দূষিত বায়ু, স্থানীয় যানবাহন, বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি কারণে হিমালয়ের পাদদেশের এই এলাকা এখন দূষণের আধার হয়ে উঠেছে।’
আজ বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) কথা হচ্ছিল কাঠমান্ডু থেকে দূরে ললিতপুর এলাকায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসিমড আয়োজিত বায়ুদূষণ নিয়ে এক কর্মশালায়। ইসিমড হলো পর্বত এলাকার সমন্বিত উন্নয়নের আন্তর্জাতিক সংস্থা। বাংলাদেশসহ হিমালয়, এর পাদদেশ এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালা এলাকার আটটি দেশ এর সদস্য। বাকি সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমার।
বায়ুদূষণের প্রকোপ কমাতে যোগাযোগ কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তার উপায় খুঁজতেই এই কর্মশালার আয়োজন। এটি চলবে দুদিন। এখানে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, গবেষক এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন।
হিমালয় এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালার এই দেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই নানা ধরনের বিভাজন রয়েছে। ভিন্নতা মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। কিন্তু বায়ুদূষণের মতো এক নীরব ঘাতক বিশ্বের ২৫ শতাংশ মানুষের বসবাসকারী এই অঞ্চলকে গ্রাস করছে। দূষণ মানছে না সীমান্তের বেড়া।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর শুধু বাংলাদেশে দূষণের কারণে ৭৮ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান কিংবা চীন সব দেশে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ দরকার। এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে তাই যোগাযোগের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে, আজকের শুরুর দিনের আলোচনায় এ আহ্বান ছিল সব বক্তার মুখে। আর উন্নত বায়ুপ্রাপ্তিকে মানবাধিকারের অংশ বলে মত দিলেন ইসিমডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পেমা জিয়ামসো। তিনি বললেন, বায়ুদূষণ একটা স্বাস্থ্য সমস্যা। বিপুলসংখ্যক মানুষ বায়ুদূষণের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষণ একটি অর্থনৈতিক সমস্যাও। দূষণের কারণে স্কুল-কলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়। বিমান পরিবহনে বা নানা ধরনের পরিবহনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তার প্রভাব অর্থনীতির ওপরে পড়ে। তাই দূষণের সঙ্গে এখন জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব মিলেমিশে গেছে। ব্যাপক দূষণ এবং দূষিত বায়ু হিমবাহের দ্রুত গলে যাওয়ায় ভূমিকা রাখছে। আর এই দূষণ মানছে না কোনো সীমান্তের বাধা। ভারতের গুজরাট থেকে মিয়ানমারের নেপিডো, পাকিস্তানের লাহোর থেকে বাংলাদেশের কোনো অঞ্চল—দূষণের কবলে সবাই বিপর্যস্ত।
পেমা বলছিলেন, এখন দূষণমুক্ত পানি বা ভেজালমুক্ত খাবার পাওয়া যদি অধিকার হয়ে থাকে তাহলে উন্নত বায়ু অবশ্যই মানুষের অধিকার হতে হবে। এই কণ্ঠটা উচ্চকিত করা দরকার। আর বায়ুদূষণ এমন সমস্যার নয় যে একে মোকাবিলা করা যাবে না। এ অঞ্চলের কিছু কিছু নগরে এমন কিছু উন্নত চর্চা হয়েছে, যাতে বায়ুদূষণ কমেছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্র যত উন্নত হবে দূষণ মোকাবিলাও তত সহজ হবে।
অনুষ্ঠানে কথা বলেন নেপালের প্রখ্যাত ইংরেজি সাময়িকী ‘হিমালয়া’র সম্পাদকদের একজন কুন্ডা দীক্ষিত। খ্যাতনামা এই সাংবাদিক ‘নেপালি টাইমস–এর সাবেক সম্পাদক। তিনি বলছিলেন, এ অঞ্চলের নগরগুলোর জলাশয়গুলো দূষিত হচ্ছে। এর নগরগুলোও দূষিত হচ্ছে। কাঠমান্ডু শহর যেমন দিন দিন দূষণের কবলে পড়ছে, এর কাছাকাছি দিয়ে চলে যাওয়া বাগমতী নদীও ভয়ানক দূষণের কবলে পড়েছে। এমন বাস্তবতা ভারতের দিল্লি, গুজরাট কিংবা পাকিস্তানের লাহোর, করাচিসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন শহরের। সঙ্গে আছে প্লাস্টিকের দূষণ। এসব নিয়ে নানা রকম কথা হয়। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এগুলো যদি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে না পৌঁছায় তাহলে এগুলো মোকাবিলায় আশানুরূপ কাজ হবে না। গণমাধ্যম সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করতে পারে। গণমাধ্যমেরই শক্তি এখানে সবচেয়ে বেশি।
আজকের অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন ভুটানের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সুনিত্রা দর্জি। ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি আয়তনের ভুটানে লোকসংখ্যা আট লাখের কিছু বেশি। সুনিত্রার দেওয়া তথ্য বলছে, সেখানে ৬৯ শতাংশ এলাকা বনভূমি রয়েছে। কিন্তু নগরে আগুন লাগলে দেবালয় যেমন রক্ষা পায় না, তেমনি বিশ্বের সুখী দেশের তালিকার শীর্ষে থাকা ভুটান দূষণের বাইরে নেই। আন্তসীমান্ত বায়ু, যানবাহন, বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি সমস্যায় ভুটানের বায়ুর মান খারাপ হচ্ছে। তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানান সুনিত্রা দর্জি।
দূষণ যে সীমান্তের বেড়া মানে না, সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরেন পাকিস্তানের সাংবাদিক আফিয়া সালাম। তিনি বলেন, বায়ুদূষণ এই হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার এলাকার দেশগুলোর অভিন্ন সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এর প্রতিকারে দেশগুলোকে কাছাকাছি আসতে হবে। বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দেখানোর চেষ্টা আছে। কিন্তু মূলত দূষণের কারণেই এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। দূষণের কারণগুলোকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে এবং তার প্রতিকার এ কাজ করতে হবে। সেখানে যোগাযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
দূষণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং উন্নতমানের তথ্য তৈরি করার তাগিদ দেন চীনের সাংবাদিক ইভান জেং। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের উন্নত এবং সঠিক তথ্য দূষণের পরিস্থিতিকে তুলে যেমন তুলে ধরতে পারে তেমনি এর বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
আজ যখন এই অনুষ্ঠান চলছিল তখন নেপালের কাঠমান্ডুর বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ১২০। এই বায়ু সংবেদনশীল জনগোষ্ঠী অর্থাৎ শিশু, বয়স্ক কিংবা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য ক্ষতিকর। আর আজ সকালে ২১১ মান নিয়ে বিশ্বের ১২৭টি শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে ঢাকার স্থান ছিল তৃতীয়।
দূষণসংক্রান্ত নানা তথ্য আছে, উপাত্ত আছে। কিন্তু এসব তথ্য–উপাত্তকে যদি মানুষের বোধগম্য না করা যায়, তবে এ সম্পর্কে সচেতনতা দূর করা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান মেহরিন মাহবুব। তিনি বলছিলেন, বায়ুদূষণ–সংক্রান্ত গণমাধ্যম বার্তার মানবিকীকরণ দরকার। বিজ্ঞানের উন্নত তথ্য, সেই তথ্যের সহযোগিতা এবং তা নীতি নির্ধারণে ব্যবহার করতে হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত আরও একাধিক আলোচক এবং বিজ্ঞানীদের পরামর্শ, তথ্য-উপাত্তের মানবিকীকরণ এ মুহূর্তে জরুরি। কারণ, শেষ বিচারে দূষণের শিকার সাধারণ মানুষ। তথ্য তৈরি হওয়া উচিত তাঁদের জন্য, তাঁদের উন্নত জীবনযাপনের জন্য।