
খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া আর কয়রা নদী। এই দুটি নদী পার হলেই চোখে ভেসে ওঠে অপার সুন্দরবন। নদীপারের গ্রামগুলোয় হাঁটলে জায়গায় জায়গায় চোখে পড়ে ঝাড় আকারে গজিয়ে ওঠা গোলপাতা। মনে হয় যেন সুন্দরবনের সবুজ ছায়া এসে মিশে গেছে এপারের গ্রামবাংলার চরভূমিতে। গোলপাতার ফাঁক গলে ঝুলে থাকে তালকাঁদির মতো থোকা থোকা ফল, যাকে স্থানীয় লোকজন গোলফল নামে চেনেন।
গ্রামবাসীর কথায়, সুন্দরবন থেকে জোয়ারের ঢেউ বয়ে আনে গোলফল, সেগুলো ভেসে এসে আটকে যায় লোকালয়ের চরভূমিতে। সেখানে অঙ্কুরিত হয়ে জন্ম নেয় নতুন গোলগাছ। সুন্দরবনের অন্যতম খ্যাতিমান পামজাতীয় উদ্ভিদ এটি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nypa fruticans। বাংলাদেশে পরিচিত ‘গোলপাতাগাছ’ নামে। শাখাহীন এই উদ্ভিদের কাণ্ড থাকে মাটির নিচে, ওপরে ছড়িয়ে পড়ে নারকেলপাতার মতো সবুজ পাতা। গাছের গোড়ায় ধরে কাঁদি কাঁদি গোলফল। ফুলগুলো মোচাকৃতির, দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড় মিটার, আর মাথার অংশের ব্যাস প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
সুন্দরবনে গোলগাছে ফুল ও ফল দেখা যায় সারা বছরই। তবে আষাঢ় মাসের দিকেই সবচেয়ে বেশি কাঁদি ধরে। প্রথমে ফুল ফোটে, তারপর ধীরে ধীরে তালের কাঁদির মতো লম্বা হয়ে ওঠে ফলভরা থোকাগুলো। প্রতিটি কাঁদিতে থাকে ৫০ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত ফল। অপরিপক্ব অবস্থায় এগুলো কালচে-বাদামি রং ধারণ করে। তিন থেকে চার ইঞ্চি লম্বা প্রতিটি কোয়া দেখতে অনেকটা ছোট আকারের নারকেলের মতো, ওজন হয় ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম। শক্ত খোসা ভেঙে ভেতরের নরম শাঁস, খেতে অনেকটা তালশাঁসের মতো। এতে আছে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ উপাদান।
লোকজ চিকিৎসায়ও গোলফলের কদর কম না। স্থানীয় লোকজন বলেন, কৃমি দমন, পানিশূন্যতা পূরণ, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি কিংবা চর্মরোগ নিরাময়ে এটি সহায়ক। শিকড় সেদ্ধ করে খেলে আমাশয় ও অনিদ্রার সমস্যার উপশম হয়। কিন্তু গোলফলের কাঁদির আসল বিস্ময় লুকিয়ে আছে এর রসে। অগ্রহায়ণ মাস এলেই গাছিরা কাঁদির ডগা নুইয়ে দেন। এরপর ধারালো দা দিয়ে কেটে দেওয়া হয় ফলভরা থোকা, আর ঝরতে থাকে স্বচ্ছ রস। এই রসের ঘনত্ব খেজুরের রসের চেয়ে অনেক বেশি। যেখানে খেজুরের ষোলো কলসি রস থেকে এক কলসি গুড় হয়, সেখানে গোলের মাত্র আট কলসি রসেই তৈরি হয় সমপরিমাণ গুড়। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর মিষ্টত্ব বেড়ে যায়। এই রস থেকে তৈরি হয় গুড়, পিঠা, পায়েস; আবার অনেকে সরাসরি কাঁচা রস পান করেন।
দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, বরগুনা ও খুলনার গ্রামাঞ্চলে গোলের গুড়ের কদর ব্যাপক। কৃষি বিভাগের হিসাবে উপকূলীয় জনপদে বছরে প্রায় ১০ হাজার টন গোলের গুড় উৎপাদিত হয়। শত শত পরিবার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ঐতিহাসিকভাবে গোলফলের কাঁদি থেকে রস সংগ্রহের সংস্কৃতি এসেছে রাখাইন জনগোষ্ঠীর হাত ধরে। ১৭৮৪ সালে আরাকান থেকে আসা রাখাইনরা কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে বসতি গড়ে তারা সঙ্গে আনে রস সংগ্রহ ও গুড় বানানোর কৌশল। সেই ঐতিহ্য আজও টিকে আছে উপকূলের গ্রামগুলোয়। সম্প্রতি বাগেরহাটের মোংলার মিঠাখালী এলাকায় বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) গোলপাতার রস থেকে গুড় উৎপাদন নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে।
তবে গোলফলের বাণিজ্যিক কেনাবেচা এখনো তেমনভাবে চালু হয়নি। সাধারণত বনজীবী বা উপকূলের মানুষই শখ করে শাঁস খেয়ে থাকেন। তবে ব্যতিক্রমও আছে। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের পাশে আবদুর রহমান শেখ চার বছর ধরে পর্যটকদের কাছে গোলফল বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। তাঁর কাছে গোলফল শুধু ফল নয়, বরং জীবিকার আশীর্বাদ।
অন্যদিকে সুন্দরবনের গভীরে যাঁরা অনুমতি নিয়ে গোলপাতা কাটতে যান, তাঁদের বলা হয় বাওয়ালি। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে তাঁদের সংগ্রহ মৌসুম। কিন্তু এই কাজ ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়ই বেঙ্গল টাইগার লুকিয়ে থাকে গোলপাতার ঝোপে, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রাণ হারানোর শঙ্কা থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এভাবেই টিকে আছে বাওয়ালি সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা।
দেশভেদে গাছটির নাম ভিন্ন হলেও বৈশিষ্ট্য এক। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একে বলা হয় গোলপাতা, মিয়ানমারে দানি, শ্রীলঙ্কায় জিং পল, মালয়েশিয়ায় বুয়াহ নিপাহ, ইন্দোনেশিয়ায় বুয়াহ আতপ, সিঙ্গাপুরে আত্তপ, ফিলিপাইনে নিপা আর ভিয়েতনামে দুয়া নুয়ক।
গোলপাতা শুধু একটি উদ্ভিদ নয়; এটি উপকূলীয় মানুষের জীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঘরের জন্য দেয় ছাউনি, খাবারের জন্য দেয় রস, ওষুধের জন্য দেয় ফল ও শিকড়। প্রয়োজন শুধু সঠিক পরিকল্পনা ও গবেষণা। তাতে একদিন গোলপাতার গোলফল হয়তো হয়ে উঠবে বাংলাদেশের উপকূলের বড় অর্থনৈতিক সম্পদ।