
সরকারি ছুটি আর বেসরকারি কর্মময়তায় শনিবার দিনটিতে মিশ্র পরিবেশ থাকে রাজধানীতে। আবার শীতের একটু আগমনী আভাস ও বিদায়ী গরমের মাখামাখিতে আবহাওয়াও হেমন্তের এই সময়ে থাকে বেশ মনোরম। সুহৃদ, শুভানুধ্যায়ী কাছের মানুষদের নিয়ে এমন পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হলো প্রথম আলোর ২৭ বছরের পথ চলা উপলক্ষে প্রীতিসমাবেশ।
আজ শনিবার রাজধানীর র্যাডিসন হোটেলের বলরুমে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল দিনের শেষে। ‘সত্যই সাহস’—এই প্রতিপাদ্য ছিল প্রথম আলোর ২৭ বছর পূর্তির আয়োজনে। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় প্রথম আলো পেরিয়ে এসেছে অনেক মাইলফলক। দেশের মানুষের গভীর আস্থা যেমন অর্জন করেছে, তেমনি প্রথম আলোর বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বমঞ্চে। এসবই তুলে ধরা হয়েছিল এই প্রীতিসমাবেশে।
বিকেল থেকেই অতিথিরা আসতে শুরু করেছিলেন। কে ছিলেন না এই সমাগমে? অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, বিদেশি কূটনীতিক, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে বিশিষ্ট রাজনীতিক, অগ্রগণ্য সাহিত্যিক, শিল্পী, ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, আইনবিদ, চিকিৎসক, পদস্থ সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, নারীনেত্রী, অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি থেকে শুরু করে সমাজের নানা ক্ষেত্রের স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্বরা তাঁদের উপস্থিতি দিয়ে অলংকৃত করেছিলেন এই আয়োজন। তাঁদের অনেকেই এসেছিলেন শুভেচ্ছার ফুল নিয়ে; জন্মদিনের আয়োজন বিধায় কেকও ছিল কারও কারও সঙ্গে।
বরাবরের মতোই আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে অতিথিরা হালকা পানীয় নিয়ে চেনাজানাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে মগ্ন হন। অনেকের সঙ্গেই অনেকের এই আয়োজনে সরাসরি দেখা হয়। তাতে হৃদয়ের উষ্ণতায় প্রীতির বন্ধন আরও নিবিড় হয়ে ওঠে।
আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, ‘২৭ বছর ধরে আমরা দেশের মানুষের গল্প বলে আসছি। তাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে এসেছি। প্রথম আলোর সেই যাত্রায় আপনারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাই সম্মিলিতভাবে আমরা আজকের এই সন্ধ্যা উদ্যাপন করব।‘
তিনি বাঁশি শোনার আমন্ত্রণ জানালেন শ্রোতাদের। মঞ্চে এলেন বংশীবাদক কামরুল হাসান। তিনি তাঁর বাদনে ছড়িয়ে দিলেন ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানের সুর।
বাদনের পর মঞ্চে এলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি অতিথিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, প্রথম আলো একটি স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সেই স্বপ্নের অনুপ্রেরণাদাতা ছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান।
মতিউর রহমান বলেন, অগণিত পাঠকের অকুণ্ঠ সমর্থন ও আস্থা ছাড়া আজকের এই অবস্থায় আসা সম্ভব ছিল না। প্রথম আলো আজ দেশের মানুষের কণ্ঠস্বর ও সমাজের বিবেকে পরিণত হয়েছে। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরে থেকেও এসেছে স্বীকৃতি। প্রথম আলো তার অবস্থান আগামীতে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। আরও আধুনিক, আরও মানবিক, মানুষের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে দেশের কল্যাণে সত্যের অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে।
এরপর দেখানো হলো প্রামাণ্যচিত্র। এ বছর জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ওয়ান ইফরার (ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পাবলিশার্স) দুটি ক্যাটাগরিতে প্রথম আলো বিশ্বসেরার পুরস্কার লাভ করেছে।
এর একটি জুলাই অভ্যুত্থানের সংবাদ প্রকাশের জন্য ‘নতুন প্রজন্মের পাঠক সম্পৃক্ততা পুরস্কার (নেক্সট জেন রিডার এনগেজমেন্ট অ্যাওয়ার্ড)। অন্যটি আঞ্চলিক বিজ্ঞাপনে সৃজনশীলতার জন্য ‘প্রিন্ট অ্যাডভারটাইজিং ক্রিয়েটিভ অ্যাওয়ার্ড’। প্রথম আলো সারা দেশের বিভিন্ন জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞাপনী ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞাপনে সৃজনশীলতা প্রকাশের জন্য এসেছে এই বিশ্বসেরা পুরস্কার।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ইনমার (ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন) অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ পুরস্কারসহ বেস্ট আইডিয়া টু এনকারেজ রিডার এনগেজমেন্ট বিভাগে প্রথম পুরস্কার, বেস্ট ইউজেস অব অ্যান ইভেন্ট টু বিল্ড আ নিউজ ব্র্যান্ড শ্রেণিতে তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছে প্রথম আলো। এসব সাফল্য নিয়েই ছিল এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর তথ্যচিত্র।
প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের পরে ছিল সাংবাদিকতায় লতিফুর রহমান স্মৃতি পুরস্কার প্রদান। সঞ্চালক সাজ্জাদ শরিফ জানান, এর আগে এই পুরস্কার পেয়েছেন রোজিনা ইসলাম, শিশির মোড়ল, সোহরাব হাসান ও এ কে এম জাকারিয়া। এবার এ পুরস্কার পাচ্ছেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন।
অনুষ্ঠানে শওকত হোসেনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান।
শওকত হোসেন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তাঁর ৩২ বছরের সাংবাদিকতার জীবনের প্রথম আলোতে কেটেছে ২১ বছর। এর মধ্যে আজ তাঁর সবচেয়ে আনন্দের দিন। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান স্বাধীন সাংবাদিকতার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন এবং সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে শিখেছেন সৎ সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতায় এখন অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছে। সেসব মোকাবিলা করে আগামীতে আরও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করার কথা বললেন তিনি।
প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেডের সিইও সিমিন রহমান তাঁর ধন্যবাদসূচক বক্তব্যে অতিথিদের উষ্ণ অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, গত ২৭ বছরে সত্য প্রকাশে অবিচল থাকার মধ্য দিয়ে প্রথম আলো সর্বস্তরের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান ছিলেন প্রথম আলোর বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার অনুপ্রেরণার উৎস।
সিমিন রহমান তাঁর বক্তব্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিক, কূটনীতিক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, লেখক, শিল্পীসহ সবার অবদান ও সহায়তার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করে তাঁদের অভিনন্দন জানান। একই সঙ্গে তিনি প্রথম আলোর কর্মীদের শুভেচ্ছা জানান।
তিনি বলেন, সম্পাদক মতিউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম আলো সাহসিকতার সঙ্গে সত্যানুসন্ধান ও দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সাংবাদিকতা করে যাবে।
আনন্দঘন এই অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল আনন্দের গানে গানে। অদিতি মহসীন পরিবেশন করলেন ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর‘। তাঁর সহশিল্পী ছিলেন সানজিদা রিমি, আদিবা কামাল, রাইসা ফাইরুজ ও অঙ্কিতা মল্লিক।
সত্যের চেয়ে সুন্দর আর কী আছে? সত্য সুন্দর, সত্যই সাহস। আলোর পথে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যাবে প্রথম আলো।