পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ছিলেন। ওই সময় প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখা পাঠানোর সুযোগ না পেয়ে দিনপঞ্জি রাখতে শুরু করেন তিনি। কয়েক দিনের দিনপঞ্জি একসঙ্গে পাঠালে তা প্রকাশ করত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাঁর দিনপঞ্জি প্রকাশ করে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আজ তাঁর ১৪ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি তুলে ধরা হলো।
দুপুরের পরপরই বোঝা যাচ্ছিল যে ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। শহরের কেন্দ্রে থাকা গভর্নরের কার্যালয়ে আঘাত হানে ভারতীয় মিগের রকেট। শহরের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল থেকে দুজন প্রতিবেদক কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসে। তারা জানায়, ভারতীয় সেনারা শহর থেকে মাত্র সাত মাইল দূরত্বে আছে এবং আর মাত্র একটি নদী পার হলেই চলবে। সংঘাত হবেই।
ভারতীয় বিমানগুলো থেকে প্রচারপত্র ফেলা হচ্ছিল শহরে, মূলত সব সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যের উদ্দেশে এই প্রচারপত্রে আত্মসমর্পণের আহ্বান ছিল। বলা হয়েছিল জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে নিকটবর্তী ভারতীয় দলের কাছে আত্মসমর্পণ করার কথা।
রেডক্রস কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকার খাদ্যদ্রব্যের মজুতের অবস্থা খারাপের দিকে। সব খাদ্য উপকরণের মজুতই কমতির দিকে, অনেক দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, কারফিউর কারণে অনেক মানুষ দোকান খুলতে পারছে না এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি এতটাই হয়েছে যে দরিদ্রদের পক্ষে বাকি থাকা খাবার কেনার সামর্থ্য থাকবে না।
এখন ভর বিকেল এবং শহরের কাছে বোমাবর্ষণের পরিমাণ আরও বেড়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এ এম মালিক ও বাকি বেসামরিক সরকারের পদত্যাগের খবর পাওয়া গেল। জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা, যিনি কিনা বেলা একটার দিকে গভর্নরের কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বললেন, মালিক পদত্যাগপত্র হাতে লিখেছেন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় ভারতীয় বিমান হামলার মধ্যেই তা লেখা শেষ হয়ে যায়। এরপর মালিক পা ধুয়ে, নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেন।
দুই বিমান হামলার মধ্যকার সংক্ষিপ্ত বিরতিতে, এখানকার মার্শাল ল আইনের উপপ্রশাসক জেনারেল রাও ফরমান আলী খান হলে দৌড়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় সেখানে থাকা জাতিসংঘের সেই কর্মকর্তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন ভারতীয়রা আমাদের সঙ্গে এমন করছে?’ জাতিসংঘের কর্মকর্তা এক সাংবাদিককে বলেন, ‘যেহেতু ওই সময়টায় আমরা সরাসরি বিমান হামলার মধ্যে ছিলাম, আমি আর রাজনৈতিক ব্যাখ্যার দিকে যাইনি।’ পাকিস্তানিরা আসলেই ভাবছে যে যুদ্ধ জেতার জন্য ভারতের এ ধরনের আচরণ কোনোভাবে অন্যায্য, খেলোয়াড়িসুলভ নয়।
পরে এক পাকিস্তানি কর্নেল হোটেলের ফটকে আসেন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, সামরিক পরিস্থিতি কেমন চলছে? তিনি বলেন, ‘খুব ভালো।’ সেনাবাহিনী কি আত্মসমর্পণ করবে? ‘অবশ্যই নয়।’ আপনারা কি লড়াই চালিয়ে যাবেন? ‘অবশ্যই।’ খুব বিনয়ী, অত্যন্ত নম্র স্বর।
আমি দরজার দায়িত্বে দুই ঘণ্টা কাটিয়েছিলাম। বেসামরিক সরকারের মন্ত্রীরা আসছিলেন, যাঁরা কিনা এখানে আশ্রয়প্রার্থী। তাঁদের ব্যাগগুলো পরীক্ষা করাই ছিল আমার দায়িত্ব। একজন প্রতিবেদকের জন্য আশ্চর্য ভূমিকা, কিন্তু সব নিয়মই এখানে খুব সহজ। মন্ত্রীদের কেউ কেউ এমনভাবে অপেক্ষা করছিলেন, যেন ব্যাগে কিছু খুঁজতে হবে। অন্যরা কৌতুক করার চেষ্টা করছিলেন। একজন বলেন, ‘ছাই থেকে ছাই এবং ধুলা থেকে ধুলা; যদি ভারতীয়রা তোমাদের না-ও পায়, মুক্তিরা অবশ্যই পাবে।’ কিন্তু নিজের কৌতুকের বিনিময়ে তিনি এক টুকরো হাসিও পেলেন না।
বিকেলের বিমান হামলার এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন আলোকচিত্রী ফিরে এলেন। তাঁরা বললেন, বেসামরিক এলাকায় রকেট আঘাত করেছে, কমপক্ষে এক ডজন বেসামরিক বাঙালির মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাস্থলে মুক্তিবাহিনীর বা পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলাদের দুজন তরুণ সদস্য উপস্থিত ছিল। কাঁপতে থাকা এক মুক্তিবাহিনীর সদস্য বলেন, ‘তারা (ভারতীয় বিমানগুলো) কেন এটি করছে? আমরা তাদের বন্ধু।’
* ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির একাংশ আবার প্রকাশ করা হলো।