
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এসেছিল কঠিন পথে; অসংখ্য মানুষের ত্যাগে ও সংগ্রামে, নানা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগে। গুরুত্বপূর্ণ সেসব ঘটনা নিয়ে এ আয়োজন।
‘১৯ এপ্রিল ৮-১০ জনের কাফেলায় রওনা হই। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটছি তো হাঁটছি। বাচ্চারা খুব কষ্ট পাচ্ছে। রাত কত জানি না, চারদিক নিস্তব্ধ। কোন দিকে বর্ডার, তা-ও জানি না। কিছু দূর যাওয়ার পর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে।’—বাংলা সিনেমার স্বনামধন্য অভিনেত্রী কবরীর লেখা।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রুপালি পর্দার সে সময়ের জনপ্রিয় এই নায়িকা হয়ে যান শরণার্থী। প্রাণ বাঁচাতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে বহু পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় পৌঁছান। এরপর পশ্চিমবঙ্গ হয়ে মুম্বাইয়ে কাটে ‘অনাহারক্লিষ্ট কর্মহীন, জীবন-মরণ লড়াইয়ে নামা’ শরণার্থীজীবন। সেই অনিশ্চিত যাত্রা, জীবনের কথা লিখেছেন আত্মজীবনী স্মৃতিটুকু থাক বইয়ে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’। চলে নির্বিচার হত্যা-বর্বরতা। প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন নিজের ঘরবাড়ি-বসতি ছাড়েন। দেশের নানা প্রান্তে তখন দেখা যায় মানুষের ছোট-বড় কাফেলা। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তাঁরা অজানা-অচেনা পথে চলেছেন। সেখানে কবরীর মতো পরিচিত মুখ যেমন আছেন; আছেন কৃষক-শ্রমিক, নারী-শিশুসহ নানা এলাকার, নানা পেশার মানুষ।
চলতি পথে অনেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন, অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়, কেউ কেউ হামলার মুখে পড়ে স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, কারও কারও সামনে প্রিয়জনকে হত্যা করা হয়, কেউ কেউ যাত্রার ধকল সইতে না পেরে পথে মারা যান। বাকিরা পথ চলতে থাকেন।
বন্ধুর যাত্রা শেষে তাঁদের ঠাঁই হয় ভারতে। ধীরাজ কুমার নাথ তাঁর শরণার্থী শিবির ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা বইয়ে জাতিসংঘের নথির ভিত্তিতে উল্লেখ করেছেন, একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে মোট ৮২৫টি শরণার্থীশিবির ছিল। এগুলোতে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৬৭ লাখ ৯৭ হাজার ২৪৫। এর বাইরে ভারতের বিভিন্ন পরিবারের সঙ্গে ছিলেন ৩১ লাখ ২ হাজার ৬০ জন শরণার্থী। সব মিলিয়ে শরণার্থীর সংখ্যা ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫।
জীবন-মরণের সীমানা
শুরুর দিকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপ সামাল দেওয়ার ব্যবস্থাপনা ভারতের ছিল না। শরণার্থীশিবিরগুলো ভরে যেতে থাকল। যাঁরা জায়গা পেলেন না, তাঁরা খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, ফুটপাতে, রেলস্টেশনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন।
শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলাম তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস বইয়ে লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার মতো কোনো দেশ থেকে এককভাবে এক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়া বা কোনো একটি দেশ এককভাবে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনা কখনো ঘটেনি।
এই বইয়ে উঠে এসেছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শরণার্থীদের জীবনযাপনের কথা। বলা হয়েছে, কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে যেসব জায়গায় শরণার্থীশিবির করা হয়, বেশির ভাগই বিরান নিম্ন জলাভূমি। সেখানে শৌচাগার বানানোর জন্য মাটি খুঁড়লেই পানি ওঠে। ফলে একেকটি শিবিরের দুই থেকে তিন লাখ শরণার্থী জলাধারের পাশে শৌচাগারের কাজ সারেন। মে মাসে বৃষ্টি শুরু হলে পরিবেশ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে কলেরার জীবাণু। আসাম ও মেঘালয়েও কলেরার ভয়াবহ প্রকোপ হয়েছিল।
কলেরায় শরণার্থীশিবিরের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তার একটি চিত্র পাওয়া যায় ধীরাজ কুমার নাথের বইয়ে। তিনি পুলিৎজারজয়ী সাংবাদিক সিডনি শনবার্গের একটি প্রতিবেদন জুড়ে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার করিমপুরের একটি শরণার্থীশিবির নিয়ে ওই সাংবাদিক লিখেছেন, যশোরের অবস্থাপন্ন কৃষক সতীশ মালাবার। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে পরিবার নিয়ে ১৩ দিন হেঁটে এখানে আসেন। কিন্তু মৃত্যুর ভয়াবহতা তাঁদের পাশ ছাড়েনি। কলেরায় প্রিয়জনদের হারিয়ে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমার বাবা, স্ত্রী, তিন ছেলে-মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। আমি বেঁচে আছি কেন?’
শরণার্থীশিবিরগুলোতে এমন ঘটনা ছিল নৈমিত্তিক। শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলাম তাঁদের বইয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করে দেখিয়েছেন, শুধু জুন-জুলাই মাসে কলেরাসহ অন্যান্য রোগে তিন লাখের বেশি শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছিল। পুরোটা সময় ধরলে, তাঁদের বিবেচনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা আরও কয়েক লাখ বেশি হবে। মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় এই বিপুলসংখ্যক মৃত্যু অনালোচিত।
ছুঁয়ে গেল বিশ্বপ্রাণ
মুক্তিযুদ্ধ সূচনা থেকে সমাপ্তি বইয়ে ‘একাত্তরের শরণার্থী’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন আশফাক হোসেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ৮ মে ভারতের পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এক বিবৃতিতে শরণার্থী সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার কিছু শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। ১৮ মে এক জনসভায় তিনি শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা অনুধাবন করতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
আশফাক হোসেন লিখেছেন, জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান শরণার্থী সমস্যাকে জাতিসংঘের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। শরণার্থী ইস্যুর ব্যাপকতাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সহানুভূতির জন্ম দিয়েছিল।
সেই সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের কথা লিখেছেন মতিউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ সূচনা থেকে সমাপ্তি বইয়ে ‘সংস্কৃতির বিশ্বস্বজন’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশ্বনন্দিত শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি ও গায়কেরা কবিতা পড়ে, কনসার্টে গান গেয়ে, ছবি এঁকে, সভা-সমাবেশ বা মিছিল করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে সমর্থন আদায়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ ছিল তাঁদের লক্ষ্য।
একাত্তরে বাংলাদেশ নিয়ে গায়ক-শিল্পীদের সবচেয়ে বড় আয়োজন ছিল ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, সঙ্গে ছিলেন ‘বিটলস’-এর গায়ক জর্জ হ্যারিসন। ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে হয় সংগীতসন্ধ্যাটি। সেখান থেকে সংগ্রহ করা ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ ডলার দেওয়া হয় ইউনিসেফের বাংলাদেশের শিশু সাহায্য তহবিলে।
মানবতাবাদী মার্কিন শিল্পী জোয়ান বায়েজ লেখেন ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি গান। নিজেই সুর করে গেয়েছিলেন। সেই গানের পঙ্ক্তিতেও ছিল শরণার্থীদের জন্য হাহাকার—‘কিশোরী মায়ের দু চোখ ভেসে যায়/ শিশুটি তার ধুঁকছে অসহায়/ বৃষ্টি আর ভীষণ কলেরায়’।
শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে সেপ্টেম্বরে ভারতে আসেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। ‘যুদ্ধের ময়দানে রচিত কবিতা’ শিরোনামে সাজ্জাদ শরিফ লিখেছেন, কবি সীমান্তের শরণার্থীশিবিরের তাঁবুতে তাঁবুতে ঘোরেন। কথা বলেন। লাখো অসহায় মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে লেখেন বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। সেটি ছাপা হয় নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়। খান মোহাম্মদ ফারাবীর অনুবাদে সেই কবিতায় ফুটে ওঠে শরণার্থীদের দুর্দশার ছবি, ‘লক্ষ প্রাণের উনিশ শত একাত্তর/ উদ্বাস্তু যশোর রোডে সব ধূসর/ সূর্য জ্বলে ধূসর রঙে মৃতপ্রায়/ হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কলকাতায়’।
ভারতের শরণার্থীশিবিরের ঘুপচি তাঁবুতে গুমরে মরা আর্তনাদ ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় বিশ্ববাসীর কাছে। তাদের হৃদয় স্পর্শ করে। বাড়িয়ে দেওয়া হাত শরণার্থীর কষ্টের জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি আনে। বাংলাদেশের বিজয়কেও ত্বরান্বিত করে।
তথ্যসূত্র:
১. স্মৃতিটুকু থাক, কবরী, বিপিএল
২. শরণার্থী শিবির ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ধীরাজ কুমার নাথ, অনন্যা
৩. মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস, শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলাম, প্রথমা প্রকাশন
৪. মুক্তিযুদ্ধ সূচনা থেকে সমাপ্তি, সম্পাদনা: সাজ্জাদ শরিফ, প্রথমা প্রকাশন