কয়েক দফা আলোচনা করেও কয়লার দাম নিয়ে ভারতের বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। দুই পক্ষের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে চুক্তির বাইরে ছাড় দিতে রাজি নয় আদানি। তারা বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে যেতে পারে।
আদানি ইতিমধ্যে আইনি পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে। আদানির একটি সূত্রও তা নিশ্চিত করেছে। বিদ্যুৎ বিভাগও আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, আদানির সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে তারা এটিকে আরবিট্রেশনের (সালিস) দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর প্রথম ধাপ হচ্ছে, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠক; যা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে মিডিয়েটর (মধ্যস্থতাকারী) নিয়োগ করা, যা এখনো হয়নি। তিনি বলেন, ‘আদানি যদি সালিসের দিকে যায়, তা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তাই অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’
ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে নির্মিত আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। ২০১৭ সালে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চুক্তি অনুযায়ী এই কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালে। চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হয় কয়লার দাম ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। তবে বিগত সরকারের আমলেই আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। বাংলাদেশ শুরু থেকেই বলছে, আদানি কয়লার দাম বেশি ধরছে।
আদানি যদি সালিসের দিকে যায়, তা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তাই অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
কয়লার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া (নিউক্যাসল ইনডেক্স) ও ইন্দোনেশিয়ার ইনডেক্স (মূল্যসূচক) বিবেচনায় নেওয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, মূল্যসূচকে উল্লিখিত দামের চেয়েও কম দামে কয়লা কেনা যায়। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা কেনা হয় বিশেষ মূল্যছাড়ে। আদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই ছাড়ের সুবিধা পায় না। এতে কয়লার দাম বেশি পড়ে এবং বিদ্যুতের বেশি দাম দিতে হয়।
পিডিবি সূত্র বলছে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মিত চীন ও এস আলম গ্রুপের যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বর্তমানে প্রতি টন কয়লার কেনা দাম পড়ছে গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে। সাম্প্রতিক হিসাবের ক্ষেত্রে পিডিবি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম ধরছে ৬৫ ডলারের আশপাশে। তবে আদানি চাইছে ৮০ ডলার। নিয়মিতভাবেই দুই হিসাবে টনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ ডলারের ফারাক থাকছে।
বৈদেশিক মুদ্রাসংকটে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে আদানির বিল বকেয়া পড়ছিল। বকেয়া বাড়তে বাড়তে ৭০ কোটি ডলার (প্রায় ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) হয়। পিডিবির হিসাবে, গত জুন পর্যন্ত আদানির বিল শোধ হয়ে গেছে। তবে কয়লার বাড়তি দাম ধরে আদানির করা বিল অনুসারে বকেয়া জমে আছে প্রায় ২০ কোটি ডলার (প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা)।
বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গত ২৩ জুন আদানি ও পিডিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠক করলেও সমাধান হয়নি। এর আগেও কয়েক দফা বৈঠক করে দুই সংস্থার প্রতিনিধিদল।
সাম্প্রতিক হিসাবের ক্ষেত্রে পিডিবি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম ধরছে ৬৫ ডলারের আশপাশে। তবে আদানি চাইছে ৮০ ডলার। নিয়মিতভাবেই দুই হিসাবে টনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ ডলারের ফারাক থাকছে।
পিডিবি সূত্র বলছে, বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় সিঙ্গাপুরের খ্যাতনামা আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডাক্সটন হিল চেম্বার্সকে নিয়োগ দিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। এর সঙ্গে থাকছে সিঙ্গাপুরের আরেক আইনি প্রতিষ্ঠান দ্য আরবিট্রেশন চেম্বার্স। আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের অভিজ্ঞ আইনজীবীরা লড়বেন আদানির হয়ে। তাই পিডিবির পক্ষ থেকেও আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
আদানির সঙ্গে পিডিবির চুক্তি পর্যালোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদানির সঙ্গে করা পিডিবির চুক্তিটি একটি ‘অসম’ চুক্তি। এখানে আদানিকে বেশ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
আদানি ও পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির করা বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মিলে পর্যালোচনা করে দেখেছে প্রথম আলো। এতে দেখা যায়, দেরিতে বিল পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশের চড়া সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা পায়রায় নেই।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অন্য সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা কেনার প্রকৃত মূল্য ধরেই খরচ হিসাব করা হয়। তবে আদানির সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুসারে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সূচকের মধ্যে গড় করে মূল্য হিসাব করতে হয়। গড় দাম ধরার কারণে আদানি কয়লার মূল্য বেশি ধরার সুযোগ পায়।
পিডিবির দাবি, আন্তর্জাতিক দুই সূচকে (অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া) বিভিন্ন মানের (ক্যালরিফিক ভ্যালু) কয়লার দাম প্রকাশ করা হয়। দুই সূচকে উন্নত মানের কয়লার দাম ধরে তার গড় হিসাব করছে আদানি। তবে তারা যে মানের কয়লা ব্যবহার করছে, তার দাম এত বেশি নয়।
আদানি ও পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির করা বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মিলে পর্যালোচনা করে দেখেছে প্রথম আলো। এতে দেখা যায়, দেরিতে বিল পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশের চড়া সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা পায়রায় নেই। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে সব খরচের দায় পিডিবির। আদানির কেন্দ্রে বিনিয়োগের বিপরীতে সব সুদের হার ভারত নির্ধারণ করবে, বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেই। পানি ব্যবহারেরও খরচ দিতে হবে, যা পায়রায় নেই।
এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ বা অসম চুক্তি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যা–ই হোক, আদানির সঙ্গে সমঝোতা করে চুক্তি সংশোধন করা যেতে পারে। এতে কাজ না হলে আদালতে গিয়ে অসম চুক্তির বিষয়গুলো বলা যেতে পারে।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম
পিডিবি সূত্র বলছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর আদানির সঙ্গে আগের সরকারের করা ‘অসম চুক্তি’ বাতিলের দাবি জোরালো হয়। কিন্তু চাইলেই চুক্তি বাতিল করা যায় না। তাই চুক্তির অসংগতি দূর করে সংশোধনের আলোচনা করা হচ্ছে। এটি করা গেলে আদানির কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের দাম কমে আসবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ বা অসম চুক্তি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যা–ই হোক, আদানির সঙ্গে সমঝোতা করে চুক্তি সংশোধন করা যেতে পারে। এতে কাজ না হলে আদালতে গিয়ে অসম চুক্তির বিষয়গুলো বলা যেতে পারে। তিনি বলেন, আদানি যদি আন্তর্জাতিক আদালতে যায়, তাহলে খরচ চিন্তা না করে আন্তর্জাতিকভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করে মোকাবিলা করতে হবে।
চুক্তি বহাল থাকলে আদানিকে বাড়তি বিল দিতেই হবে। আন্তর্জাতিক আদালতেও তারা সুবিধা পাবে। তাই অসম চুক্তি করে ঠকানোর অভিযোগে স্থানীয় আদালতে আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিলের মামলা করা উচিত সরকারের।ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছিল, যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। পাশাপাশি ভারত ও নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ভারত থেকে ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি রয়েছে। এর মধ্য ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট ভারত সরকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসে। বাকিটা ভারতের বিজেপি সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আদানির কাছ থেকে আনা হয়। নেপাল থেকে আনা হয় ৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটে খরচ হয়েছে ১৪ টাকা ৮৭ পয়সা। একই সময়ে ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানির ক্ষেত্রে গড়ে ইউনিটপ্রতি খরচ ৮ টাকা ৪০ পয়সার মতো।
বাংলাদেশে পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন খরচ পড়ে ইউনিটপ্রতি ১২ টাকার কম। মাতারবাড়ীর সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি এখনো হয়নি। তবে চুক্তির জন্য দাম ঠিক করা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। জাপানের অর্থায়নে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছে সরকারি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি বহাল থাকলে আদানিকে বাড়তি বিল দিতেই হবে। আন্তর্জাতিক আদালতেও তারা সুবিধা পাবে। তাই অসম চুক্তি করে ঠকানোর অভিযোগে স্থানীয় আদালতে আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিলের মামলা করা উচিত সরকারের। তিনি বলেন, এর আগে বিদেশি কোম্পানি নাইকোর বিরুদ্ধেও স্থানীয় আদালতে মামলা করে জিতেছিল সরকার।