সৈয়দ আব্দুল হাদী
সৈয়দ আব্দুল হাদী

ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো–৮

সৈয়দ আব্দুল হাদীর জীবনের গান

‘আমার জন্মের আগে আমার নানির একটি পুত্রসন্তান জন্মেছিলেন। কিন্তু জন্মের পরপরই তিনি মারা যান। নানি সারা দিন কান্নাকাটি করতেন। আমার বাবা দেখলেন যে তাঁকে আর অন্য কোনোভাবে থামানো যাবে না। বাবা তখন বলেছিলেন যে ঠিক আছে, মা, এই ছেলেকে আপনাকে দিয়ে দিলাম। এটা আপনার।’

জীবনের গল্প শুনছিলাম সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর মুখে। ‘ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো’ শীর্ষক প্রথম আলোর ভিডিও সাক্ষাৎকারমালার অংশ হিসেবে।

বাংলাদেশের পথিকৃৎ সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। ১৯৪০ সালে আগরতলায় জন্ম। ৮৫ পেরিয়েছেন। পাকিস্তান হওয়ার পর, ক্লাস ফোরে পড়ছেন যখন, পিতা তাঁকে তাঁর কর্মস্থল সিলেটে নিয়ে আসেন। শৈশবের আগরতলা ভুলতে পারেন না। প্রথম স্কুল ছিল উমাকান্ত একাডেমি। তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

আব্দুল হাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই গায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। সিনেমায় গান করেন ১৯৬০ সালে, কুড়ি বছর বয়সে, ২২ বছর বয়সে রেডিওতে। ১০ টাকা পেয়েছিলেন, সেটা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কাটলেট খাওয়া আর সিনেমা দেখার পরও কিছু টাকা পকেটে রয়ে গিয়েছিল।

সৈয়দ আব্দুল হাদীর মুখে শোনা যাক, ‘আমাদের শহর তো গানবাজনার জন্য বিখ্যাত ছিল—ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরিবার সেখানেই ছিল। আমার চেয়ে বয়সে একটু বড় কিন্তু খুব বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল রাজা হোসেন খানের সঙ্গে। খুবই গুণী একজন সুরকার ছিলেন। আমার বাসার কয়েকটা বাসা পরেই ওঁদের বাসা ছিল। ওখানে তিনি রেওয়াজ করতেন, সেতার। আমি স্কুলে যেতাম ওই রাস্তা দিয়ে। শুনে আমার প্রচণ্ড আকর্ষণ হলো এটা একটু শিখতেই হবে। তাঁকে গিয়ে ধরলাম ভাই, এটা তুমি আমাকে শেখাও। উনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন ওস্তাদ ইসরাইলের কাছে। আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, আমি তো এটা শিখতে চাই। তো উনি একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে আমি কি শিখতে পারব এটা? অসম্ভব। তবু তিনি বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে, এসো। তো কয়েক দিন অনুশীলন করলাম। শিখলাম। এরপর হাতের আঙুলে তারের ঘষায় ফোসকা পড়ে গেল। আমি বললাম, ওস্তাদজি, আমি পারছি না তো। উনি হাসতে হাসতে বললেন, বাবা, এটা তোমার কাজ না। তুমি বরং গান করো। অনেক ভালো করবে।’

ওস্তাদ ইসরাইলের পরামর্শে সেতার থেকে এলেন গানে।

সেখানে গান করেন। রেডিওর প্রথম গান, টেলিভিশনের প্রথম গান, দুটোই ছিল কবি শামসুর রাহমানের লেখা।

আব্দুল হাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই গায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। সিনেমায় গান করেন ১৯৬০ সালে, কুড়ি বছর বয়সে, ২২ বছর বয়সে রেডিওতে। ১০ টাকা পেয়েছিলেন, সেটা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কাটলেট খাওয়া আর সিনেমা দেখার পরও কিছু টাকা পকেটে রয়ে গিয়েছিল। জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেন। তারপর টেলিভিশন চালু হলে তাতে যোগ দেন তিনি। সেখানে গান করেন। রেডিওর প্রথম গান, টেলিভিশনের প্রথম গান, দুটোই ছিল কবি শামসুর রাহমানের লেখা।

এরপর হাতের আঙুলে তারের ঘষায় ফোসকা পড়ে গেল। আমি বললাম, ওস্তাদজি, আমি পারছি না তো। উনি হাসতে হাসতে বললেন, বাবা, এটা তোমার কাজ না। তুমি বরং গান করো। অনেক ভালো করবে।’

আমজাদ হোসেনের ছবিতে গান গেয়ে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ‘আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার’ তো কিংবদন্তি হয়ে গেছে। ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’ গানটা তাঁকে গাইতে হয়েছে ভাঙা গলায়। কারণ, সিনেমায় নায়কের গলায় একাত্তরে গুলি লেগেছিল, তাই পরিচালক বলেছেন, গলাটা ভাঙা ভাঙা হতে হবে। পেয়েছেন একুশে পদক। পেয়েছেন মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। জীবনের গান নামে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া একটা আত্মজীবনী আছে তাঁর।

স্ত্রী মারা গেছেন। তিন কন্যা প্রবাসী। তবু দেশ ছাড়বেন না সৈয়দ আব্দুল হাদী। বারবার করে বলেন, জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়। অনেক দেশাত্মবোধক গান করেছেন এই নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। শেষ করলেন এই গানটা গেয়ে:

যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা

দে না তোরা দে না

সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না...।

  • আনিসুল হক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক