
কক্সবাজার শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়ন। ঘন সবুজে ঘেরা চারপাশ। ছোট ছোট টিলার ওপর বাড়িঘর। লালমাটির উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় ঘরগুলোতে। বন বিভাগের জমি লিজ নিয়ে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন।
ইউনিয়নটির উত্তর পুকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা কুলসুমা খাতুন (৪২)। ৫ বছর আগে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তিনি বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন দুই সন্তান নিয়ে। অর্ধাহারে-অনাহারে যখন দিন কাটছিল, তখন বাবা বলেছিলেন, কুলসুমা যেন সন্তান দুটিকে তাঁর সাবেক স্বামীর কাছে দিয়ে আসেন।
অভিমান নিয়ে দিনমজুর হিসেবে অনিয়মিতভাবে জমিতে কাজ শুরু করেন কুলসুমা। দেড় বছর আগে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা পান তিনি। এখন তিনি নিজেই কৃষক হিসেবে আয় করছেন। তাঁর মেয়ে জোবাইদা আক্তার উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
গত ৯ এপ্রিল গ্রামটিতে গিয়ে দেখা হয় কুলসুমার সঙ্গে। তিনি ছাড়াও গ্রামটির নূরজাহান বেগম (৪২), রাজিয়া বেগম (৩৮), রোজিনা আক্তার (৩৭), নূর আয়েশা (৩৬), ফাতেমা বেগমের (২৭) মতো অন্তত ১০ জন নারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, তাঁদের একক আয়ে সংসার চলছে অথবা সংসারের হাল তাঁরা সমানভাবে টানছেন।
পরদিন ১০ এপ্রিল কক্সবাজার সদরে অবস্থিত যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা হয় কবিতা রানি দে, জয়নাব বেগম, তানজিনা আক্তার প্রিয়া, সানজানা সোমাইয়ার মতো উদ্যমী কর্মজীবী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, যাঁরা আয় না করলে সংসার চলত না, ভাইবোনেরা পড়াশোনা করতে পারত না।
নারীর উপার্জন করা, স্বাবলম্বী হওয়া নিয়ে অনেকে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তবে এই নারীরা বলছেন, কে কী বলল, তা দেখে তাঁরা কাজ করেন না। প্রয়োজনেই তাঁরা কাজে যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা উপার্জন করেন বলেই সংসারের চাকা সচল রয়েছে।
নারীর কাজে যুক্ত হওয়া নিয়ে সমাজের একটা অংশের মানুষের মধ্যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার বিষয়টি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’-এ উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনে ‘ওয়ার্ল্ড ভ্যালুস সার্ভে’-এর ৮৪টি দেশের ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বিশ্বের ৪৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ মনে করেন, মা চাকরি বা ঘরের বাইরে কাজ করলে সন্তানের দুর্ভোগ হয়। বাংলাদেশে এ হার ছিল সবচেয়ে বেশি—৮৭ শতাংশ।
এ ধরনের নেতিবাচক মনোভাব নারীর প্রতি বৈষম্য বাড়ায় বলে মনে করেন গবেষকেরা। তাঁদের মতে, নারীর কাজে যুক্ত হওয়া, উপার্জন করা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই অবান্তর।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ২০২৪ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ প্রতিবেদন অনুসারে, এক বছরে অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। ফলে বৈশ্বিক লিঙ্গভিত্তিক সমতা সূচকে আগের বছরের চেয়ে ৪০ ধাপ নেমে গেছে বাংলাদেশ। ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫৯তম। ২০২২ সালে তা ছিল ৭১তম।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের উত্তর পুকুরিয়া গ্রামের কুলসুমা বলছিলেন, বিবাহবিচ্ছেদের পর অন্যের জমিতে কাজ করতেন তিনি। সে সময় ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালো কিছু খেয়েছেন বলে মনে পড়ে না তাঁর।
কুলসুমা বলেন, ‘এখন সবজি করি, ধান চাষ করি, হাঁস-মুরগি পালি। সেসব বিক্রি কইরা ছেলেমেয়েদের ভালো খাওয়াই, নিজে খাই। আগে কোনো দিন ভালো খাই নাই। কাজ করি বলেই সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছি।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে কুলসুমার। তিনি বলেন, ‘আমার কষ্ট আমার মেয়েটা বেশি বোঝে। বলে, মা আমি পড়ালেখা শেষ করব। চাকরি কইরা তোমাকে খাওয়াব।’
একই গ্রামের নূরজাহানের দুই মেয়ে, এক ছেলে। স্বামী দিনমজুর। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। পাঁচ বছর আগে বড় মেয়েকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে বাল্যবিবাহ দিয়েছিলেন। দুই মাস আগে চার বছরের সন্তানসহ এই মেয়ে ফিরে এসেছে। আরেক মেয়ে স্কুলে পড়ছে। নূরজাহান জানান, তিনিও জমিতে সবজি চাষ করেন, তাঁর গরু আছে। সবজি চাষ আর গরু পালন থেকে তাঁর মাসে আয় হয় ছয় হাজার টাকা। তিনি যখন আয় করতেন না, তখন তাঁদের সংসারে অনেক টানাটানি ছিল।
একই কথা বললেন বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া তিন সন্তানের মা রাজিয়া। তিনি ছাগল বিক্রি করে লাভ থেকে সেলাই মেশিন কিনেছেন। এখন এ থেকে উপার্জন করছেন।
এই নারীরা জানান, আয় করার জন্য তাঁরা ‘ইমপ্রুভিং স্কিলস অ্যান্ড ইকোনমিক অপরচুনিটিস ফর উইমেন অ্যান্ড ইয়ুথ ইন কক্সবাজার, বাংলাদেশ (আইজেক)’ নামের একটি প্রকল্প থেকে সহায়তা পেয়েছেন।
শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত নয়, কক্সবাজারের এমন ২৪ হাজার ৭৬০ জন কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাজার উপযোগী কর্মসংস্থান ও স্বনির্ভর হাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে ২০২৩ সালে আইজেক শুরু হয় বলে জানান প্রকল্পপ্রধান খন্দকার ফখরুল আলম। তিনি আরও জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১২ হাজার ৫১৭ জনের কাছে পৌঁছানো গেছে। গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার আর্থিক সহায়তায় ব্র্যাক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত আছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরও। চলতি বছর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
প্রকল্পের সুবিধাভোগী কুলসুমা বলেন, এখন তাঁর মাসে আয় হয় ৮ হাজার টাকা। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁকে বন বিভাগ থেকে ৪০ শতাংশ জমি ৬ মাসের জন্য লিজ দেওয়া হয়। জমির অর্ধেকে আলু, টমেটোসহ হরেক রকমের শাকসবজি রোপণ করেন। বাকি অর্ধেকে ধান চাষ করেন। এখন তিনিই লিজের অর্থ (১০ হাজার টাকা) বহন করেন। ধান ও শাকসবজি বিক্রির লাভ থেকে হাঁস-মুরগি কিনেছিলেন। পরে সেলাই মেশিন কিনে আয় শুরু করেন। এবার রোজার আগে তিনি ২৫ হাজার টাকায় একটি ষাঁড় কেনেন। ঈদুল আজহায় ষাঁড়টি ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
আইএলওর তথ্য অনুসারে, কক্সবাজারে ২৬ লাখের বেশি বাংলাদেশির বাস। জাতীয় গড়ের সঙ্গে তুলনা করলে কক্সবাজারে আনুমানিক ৩৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। শ্রমবাজারে এখানকার নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৬ শতাংশ। এলাকায় মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে কৃষি, মাছ ধরা ও পর্যটন। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে পৌনে ৫ লাখ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কোনো কাজে নেই। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৪ লাখের বেশি।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা কবিতা রানি দে। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ১০ এপ্রিল কক্সবাজার সদরের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে। সেখানে তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ শিখে এখন উপার্জন করছেন। মা ও ছয় ভাইবোন নিয়ে তাঁর সংসার। অভাবের কারণে পড়ালেখা বেশি দূর করতে পারেননি। কবিতা জানান, পান ব্যবসায়ী বাবা ভোলা রাম দে ২০১৮ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বড় বোন ববিতা রানি দে বিশ্বব্যাংকের বৃত্তি নিয়ে মিডওয়াইফারি (ধাত্রীবিদ্যা) বিষয়ে ডিপ্লোমা করছেন। ভাই বাবলা চন্দ্র দে কক্সবাজার জেলা কলেজ থেকে এবার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। টিউশনি করে নিজের পড়াশোনা করেন, আর সংসারে কিছু খরচ দেন। এসএসসি পরীক্ষার্থী কবিতা নির্মাণাধীন সড়কে রাজমিস্ত্রির কাজ করে মাসে ছয়-সাত হাজার টাকা আয় করেন। পাশাপাশি সেলাই করে আরও দুই-তিন হাজার টাকা আয় করেন।
রাজমিস্ত্রির প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রসঙ্গে কবিতা বলেন, ‘মা শুনে বলেছিলেন, এগুলো পুরুষের কাজ, তুমি কি করবা শিখে?’ মাকে বলেছিলাম, ‘এ যুগে কোনো কাজে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই।’
কবিতা বলেন, ‘কাজটা আমার খুব দরকার ছিল। আমাদের সামান্যতম সহযোগিতা করার লোক নেই। তাই লোকজন কী বলবে, তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।’
হাউসকিপিং (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা) বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরে কাজে ঢুকেছেন কলেজছাত্রী জয়নাব বেগম (২১)। তিনি জানান, কক্সবাজার সদর উপজেলা বাস টার্মিনালের কাছে তাঁদের পৈতৃক বাড়ি। তাঁরা চার বোন। তিনি দ্বিতীয়। এক বোন প্রতিবন্ধী। দিনমজুর বাবার আয় দিয়ে সংসার খুব কষ্টে চলত। তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি গত বছরের নভেম্বরে কক্সবাজার বিমানবন্দরে হাউসকিপিংয়ের কাজে যোগ দেন।
জয়নাব বলেন, ‘আব্বু একা সংসার টানতে পারেন না। আব্বুর অনেক কষ্ট হয়। তাই কাজে যোগ দিয়েছি। সার্ভিস চার্জসহ মাসে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা পাই।’
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের (কক্সবাজার) উপপরিচালক ও আইজেক প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তাই নারীদের পিছিয়ে রেখে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। প্রশিক্ষণগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এক নারীর স্বাবলম্বী হওয়া আরও অনেক নারীকে উদ্বুদ্ধ করে। তেমনটাই দেখা গেল কক্সবাজারের একটি কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা হাফসা নূরীর ক্ষেত্রে। তিনি গাড়ি চালানোর (ড্রাইভিং) ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাতায়াত করা কিছু গাড়ির চালক নারী। তাঁদের দেখে আমি উদ্বুদ্ধ হয়েছি। আমিও গাড়িচালক হয়ে আয় করতে চাই।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, একজন নারী বা পুরুষ কর্মক্ষম বয়সে উপার্জন করবেন, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এ দেশে সামাজিক আচরণগত প্রবণতা নারীর উপার্জনকে আলাদা করে দেখছে, প্রশ্ন তুলছে। এ ধরনের প্রশ্ন তোলা অবান্তর। একজন নারী উপার্জন করবেন কি করবেন না, তাঁর উপার্জিত অর্থ কোথায় ব্যয় করবেন, সেই স্বাধীনতা তাঁর থাকা উচিত। সামাজিক প্রবণতার পাশাপাশি কাজের সুযোগ কম থাকা, অসম প্রতিযোগিতা, বেশি মুনাফার কাজে পুরুষকে নিয়োগ করা, পুরুষ ও নারীর কাজে ভেদাভেদ করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা কম থাকা—এসব বিষয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণকে আরও বাধাগ্রস্ত করছে, অসমতা সৃষ্টি করছে। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়াতে তাদের দক্ষতা ও তথ্যে প্রবেশাধিকার বাড়াতে হবে। নারীর উপার্জন নিয়ে সামাজিক প্রবণতা ও পুরুষের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ পরিবর্তনে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।