
ভূমি নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) শেষে বালাম বইয়ে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত হয়েছে—এ তথ্য ক্রেতাকে জানাতে নোটিশের বিধান রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান জিনাত আরা। পাশাপাশি দলিলে জমির শ্রেণি প্রতারণামূলকভাবে পরিবর্তন করে কর ফাঁকি দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার বিধান রাখারও প্রস্তাব করেছেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি।
অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ভবনে অবস্থিত সলিসিটর অনুবিভাগের সম্মেলন কক্ষে ‘দ্য রেজিস্ট্রেশন (সংশোধিত) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বিষয়ে এক মতবিনিময় সভায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ কথা বলেন। আজ শনিবার সন্ধ্যায় এই মতবিনিময়ের আয়োজন করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ।
অধ্যাদেশের খসড়ায় উল্লেখিত এক বছরের মধ্যে জমি রেজিস্ট্রির দলিল (মূল দলিল) পক্ষকে দিতে হবে—এমন প্রস্তাব প্রসঙ্গে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান জিনাত আরা বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে, জমি রেজিস্ট্রেশন করার পর বারবার করে লোক পাঠাতে হয়। উঠেছে বালামে? না ওঠে নাই।…ব্যক্তিগত এমন অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই কারও কারও আছে। ফলে রেজিস্ট্রেশন শেষ করার পরে অবশ্যই একটি নোটিশের বিধান রাখতে হবে। ৩০ দিনের মধ্যে ক্রেতা বা মনোনীত ব্যক্তির প্রতি নোটিশ দিয়ে বলে দিতে হবে, যে বালামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তা না হলে মানুষ জানতে পারবে না।’
দেশে ভূমি জরিপ অনেক দীর্ঘ বিরতিতে হয় উল্লেখ করে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, এই সময়ের মধ্যে অনেক ভূমির প্রকৃতি ও শ্রেণি পরিবর্তন হয়। বাস্তবে জমির শ্রেণি একরকম থাকলেও দলিলে অনেক সময় জমির শ্রেণি ভিন্ন দেখানো হয়। এ জন্য দলিলে জমির শ্রেণি প্রতারণামূলকভাবে পরিবর্তন করে কর ফাঁকি দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে বিধানের কথা প্রস্তাব করেন তিনি।
গুলশান এবং বেশ কিছু এলাকাতে ‘মৌজা রেট’ যা হওয়া উচিত, তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ কম বলে সভায় উল্লেখ করেন জিনাত আরা। তিনি বলেন, দলিল নির্ধারিত মৌজার রেট দিয়ে করে ফেলে, তার ওপরে যায় না।…দুঃখজনক অনেক সময় বলা হয়, যে মৌজা রেট তো—এই আছে। এর ওপরে করা যাবে না। কিন্তু আইনের উদ্দেশ্য তা নয়। তাহলে কী দাঁড়াল? আসল মূল্যটা লেখা হয় না। আসল মূল্যটা লেখা না হয়ে মৌজা রেটের জন্য দুটি বিষয় হয়। একটি হচ্ছে কালোটাকা বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা জমি ক্রয়ের মাধ্যমে সমন্বয় হয়। আরেকটি হচ্ছে দেশে জমি রেজিস্ট্রেশন, অগ্রিম আয়করসহ এত বেশি টাকা দিতে হয়, যা পৃথিবীর আর কোথাও হয় না বলে মনে হয়।’
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি জিনাত আরা বলেন, মৌজা রেটে প্রকৃত বাজারমূল্য যদি ঠিক করা যেত এবং একই সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন খরচ, অগ্রিম আয়করসহ সব মিলিয়ে যে খরচাটা পড়ে, তা কমানো যেত; তাহলে সরকারের রাজস্বেরও কোনো কমতি হতো না। পাশাপাশি মনে হয়, সবাই, বিশেষ করে যাঁরা অল্প দামে জমি বিক্রি করেন, প্রত্যেকেরই একটা রিলিফ হতো।
আয়োজকেরা জানান, রেজিস্ট্রেশন আইনটি ১৯০৮ সালের। সর্বশেষ ২০০৪ সালে সংশোধন করা হয়েছিল। জনগণের জন্য রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করতে ও ভোগান্তি লাঘবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় শুরুতে রেজিস্ট্রেশন (সংশোধিত) অধ্যাদেশের খসড়া তুলে ধরেন আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আজিজুর রহমান। সংশোধনীর খসড়ায় ডিজিটাইজড রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি প্রবর্তনে বিধান (অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন) যুক্ত করা ও বিধি প্রণয়ন; চুক্তিনামা (জমির বায়নানামা) রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিন করার প্রস্তাব রয়েছে। বিদ্যমান আইনে দেশের বাইরে সম্পাদিত যেকোনো চুক্তি হলে তা চার মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে এই সময়সীমা আরও দুই মাস বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে বিক্রয় দলিলের ক্ষেত্রে নামজারির বিধান রয়েছে। এর পাশাপাশি খসড়ায় গিফট দলিল (হেবানামা) ক্ষেত্রেও নামজারি ও বিক্রয় দলিলের অন্য শর্তগুলো প্রয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন শেষ হওয়ার এক বছরের মধ্যে ক্রেতাকে মূল দলিল দেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে খসড়ায়।
সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক বোরহান উদ্দিন খান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম, আইন মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল কনসালট্যান্ট তানিম হোসেইন শাওন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাইম আহমেদ ও খান মোহাম্মদ মইনুল হাসান এবং চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
অন্যদের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব লিয়াকত আলী মোল্লা, নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক কাজী আবদুল হান্নান, আইন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. খাদেম উল কায়েস, যুগ্ম সচিব মো. আজিজুল হক ও হাসান মাহমুদুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।