আদিল মুহাম্মদ খান
আদিল মুহাম্মদ খান

আদিল মুহাম্মদ খানের সাক্ষাৎকার

ভূমিকম্পে আশ্রয় নেওয়ার মতো খোলা জায়গা নেই ঢাকায়

আজ শুক্রবার সকালে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় তীব্র ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষই আজ বাসায় অবস্থান করছিলেন। তীব্র কম্পনে ভবন দুলতে থাকায় আতঙ্কিত লোকজন বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার বাসিন্দারা বাসার সামনের সরু সড়কে অবস্থান নেন, যার দুই পাশেই উঁচু উঁচু ভবন। ভূমিকম্পের পরপর পরাঘাতের ঝুঁকি থাকায় নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য লোকজন বেরিয়ে এলেও তারা কি সেই নিরাপদ স্থানে যেতে পেরেছিলেন? এ রকম দুর্যোগে আতঙ্কিত মানুষের আশ্রয় নেওয়ার মতো খোলা জায়গা কি ঢাকা শহরে আছে? এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।

প্রশ্ন

ঢাকা শহরে নগর-পরিকল্পনা অনুসারে কি পর্যাপ্ত খোলা জায়গা আছে?

আদিল মুহাম্মদ খান: আজকের ভূমিকম্পের মতো বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় ঢাকা শহরে জনসাধারণের আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ ও খোলা জায়গার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে মানুষ যখন হুড়োহুড়ি করে বের হয়ে একটু নিরাপদ বা খোলা জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন অধিকাংশ এলাকায়ই সেই খোলা জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না।

ঢাকা শহর এমনভাবে তৈরি ও সম্প্রসারিত হয়েছে যে অধিকাংশ এলাকায়ই ফাঁকা জায়গা নেই। যেগুলো ছিলো, সেগুলোও ধীরে ধীরে কনভার্ট (পরিবর্তিত) হয়ে গেছে। ফলে ভূমিকম্প বা বড় কোনো বিপর্যয়ের সময় যেখানে গিয়ে মানুষ দাঁড়াতে পারবে, তেমন জায়গা অধিকাংশ এলাকায়ই অনুপস্থিত।

নগর-পরিকল্পনার মৌলিক ব্যাকরণ অনুযায়ী প্রতিটি এলাকাতেই হাঁটার দূরত্বের মধ্যে (ওয়াকিং ডিসট্যান্সে) একটি খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা থাকা প্রয়োজন। এসব স্থান দুর্যোগের সময় কমিউনিটি স্পেস হিসেবে কাজে লাগতে পারে।

নগর-পরিকল্পনার প্রাথমিক নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিককে ৫০০ থেকে ৮০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে একটি খোলা জায়গা, গ্রিন স্পেস বা পার্কের সুবিধা দিতে হবে। ঢাকার মতো জনঘনত্বপূর্ণ এলাকায় এই দূরত্ব অবশ্যই ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকার কথা।

ভূমিকম্পে আতঙ্কিত লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে বাসার সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ান। আজ শুক্রবার সকালে ঢাকার তেজকুনিপাড়া এলাকা
প্রশ্ন

একটি নগরে কত শতাংশ উন্মুক্ত জায়গা থাকা উচিত?

আদিল মুহাম্মদ খান: শহরগুলোয় ২০ থেকে ২৫ ভাগ গ্রিন স্পেস (সবুজ জায়গা) থাকা আবশ্যক। অথচ ঢাকায় এই গ্রিন স্পেসের পরিমাণ কমে ৫ শতাংশ বা তার নিচে নেমে এসেছে। পৃথিবীর সব শহরে এসব মৌলিক বিষয় অনুসরণ করা হয়। কিন্তু ঢাকা শহরের সম্প্রসারণে এসব ভাবনা নিয়ে রাষ্ট্র কাজ করছে না।

খোলা জায়গা বা খেলার মাঠ তৈরি করা ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিয়ে পরিকল্পনার মধ্যে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, কারণ, ভবন ভেঙে পড়লে সেই ধ্বংসাবশেষ সরাতে রাষ্ট্রকেই ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি শৈথিল্য দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সাম্প্রতিক ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) এ–ও বলা হয়েছে যে এ ধরনের খেলার মাঠ ও খোলা জায়গার ব্যাপক সংকট রয়েছে। সংখ্যাগুলো দেওয়া থাকলেও এগুলো তৈরি করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

উচ্চতার সঙ্গে কম্পন অনুভূতির সম্পর্ক রয়েছে। বহুতল ভবনে (যেমন ছয়তলা বা বারোতলা) কম্পনের প্রভাব বেশি হয় এবং এটি বেশি সুইং (দুলতে) করে। অন্যদিকে, গ্রাউন্ড ফ্লোর বা নিচের তলায় (যেমন দুইতলায়) ধসে যাওয়ার একটি ঝুঁকি থাকে।

ভূমিকম্পের আতঙ্কে লোকজন বাইরে বের হয়ে আসেন। আজ শুক্রবার সকালে পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকা
প্রশ্ন

ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কী করা দরকার?

আদিল মুহাম্মদ খান: যে মাত্রায় ভূমিকম্প হয়েছে এবং যেভাবে ঝাঁকুনি হয়েছে, সে তুলনায় আল্লাহর রহমতে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। তবে অনেক ভবন দেবে গেছে। ঢাকা শহর এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে অধিকাংশ এলাকায় কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। যেগুলো ছিল, সেগুলোকে কনভার্ট (রূপান্তর) করে ফেলা হয়েছে। ঢাকা শহরে ভূমিকম্প বা অন্য কোনো দুর্যোগে মানুষ যে খোলা জায়গায় দাঁড়াবে, সে সুযোগ নেই। ঢাকায় শত শত খোলা জায়গা তৈরি করা দরকার ছিল, কিন্তু রাষ্ট্রের উদ্যোগ না থাকায় বেসরকারি উদ্যোগে কখনোই এটা করা হবে না। এই উদাসীনতা দুর্যোগের সময় ঢাকাবাসীর জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। খেলার মাঠগুলোকে শুধু খেলাধুলা নয়, দুর্যোগেও আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।