Thank you for trying Sticky AMP!!

এক স্বপ্নবান তরুণের স্বপ্ন সফল করার গল্প

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।

প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছোট্ট একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘গোযায়ানের যাত্রা শুরু’। সেখানে লেখা ছিল, ‘ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের অনলাইন সেবা দিতে যাত্রা শুরু করেছে “গোযায়ান” নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। রাজধানীর একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ। গোযায়ান ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বুকিং দিতে পারবেন ব্যবহারকারী। এ ছাড়া স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার জানা, অনলাইন হোটেল বুকিং সুবিধার মতো নানা সুবিধা দিতে গোযায়ান কাজ করবে।’

সেই গোযায়ান নিয়ে প্রথম আলোতেই সর্বশেষ সংবাদটি ছাপা হয় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের গোযায়ান কিনল পাকিস্তানি স্টার্টআপ’। সংবাদটিতে লেখা হলো, ‘পর্যটকদের অনলাইনভিত্তিক নানা রকম সেবা দিতে ২০১৬ সালে পাকিস্তানের পাঁচ তরুণ মিলে শুরু করেছিলেন ফাইন্ড মাই অ্যাডভেঞ্চার নামের স্টার্টআপ। তার এক বছর পর বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে গোযায়ান শুরু করেছিলেন তরুণ উদ্যোক্তা রিদওয়ান হাফিজ। পাঁচ বছর পর সেই গোযায়ানই কিনে নিল পাকিস্তানের ফাইন্ড মাই অ্যাডভেঞ্চারকে।’

চার মাস আলাপ-আলোচনার পর গত মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানি স্টার্টআপ কোম্পানিটি কেনার চূড়ান্ত চুক্তি করে বাংলাদেশি গোযায়ান। ৩৫ লাখ মার্কিন ডলার বা ৩০ কোটি টাকায় অধিগ্রহণ করা পাকিস্তানি স্টার্টআপটি এখন গোযায়ান নামেই পরিচালিত হবে। শুরু থেকে ফাইন্ড মাই অ্যাডভেঞ্চারের প্রধান কার্যালয় ছিল করাচি। গোযায়ান কিনে নেওয়ায় এখন সেটির প্রধান কার্যালয় হচ্ছে ঢাকায়। তবে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে করা হয়েছে পরিচালন কার্যালয়।

Also Read: বাংলাদেশের গোযায়ান কিনল পাকিস্তানি স্টার্টআপ

২০১৭ সালে যাত্রা শুরুর দুই বছর পর সিঙ্গাপুরে নিবন্ধন নেয় গোযায়ান। পাকিস্তানি স্টার্টআপ কিনতে বাংলাদেশ থেকে কোনো অর্থ বিদেশে নেননি রিদওয়ান হাফিজ। এ ক্ষেত্রে গোযায়ানের ব্যবসা সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করেছে স্টার্টআপ খাতে বিশ্বের অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ডিএসটি গ্লোবাল। সঙ্গে রয়েছে নরডস্টার পার্টনার্স ও পেব্যাকের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালেক্সান্ডার রিটওয়েগার।

গোযায়ানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিদওয়ান হাফিজ তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমরা গোযায়ানকে বৈশ্বিক কোম্পানি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছিলাম। পাকিস্তানের বাজার সম্ভাবনাময় হওয়ায় সেখানেই আমরা প্রথম বিনিয়োগ করলাম। ফাইন্ড মাই অ্যাডভেঞ্চার কেনার পর বিশ্বের ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়ার সুযোগ পাবে গোযায়ান। সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রথম স্টার্টআপ হিসেবে বিদেশি কোনো স্টার্টআপকে কিনে নিল গোযায়ান। এটি গোযায়ানের জন্য অনেক বড় গর্বের বিষয়।’

মাসে সাত লাখ মানুষ গোযায়ানের ওয়েবসাইটে ঢুঁ দেন। তার মধ্যে প্রায় দুই লাখ সেবা নেন। বর্তমানে স্টার্টআপটির কর্মীর সংখ্যা ৮০।

গোযায়ানে বিদেশি বিনিয়োগ

গোযায়ান গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ২৬ লাখ মার্কিন ডলার বা ২২ কোটি ১০ লাখ টাকার বিদেশি বিনিয়োগ পায়। সিড রাউন্ডে নতুন এ বিনিয়োগের নেতৃত্ব দিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রযুক্তি খাতের অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েভমেকার পার্টনার্স। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আছে ১৯৮২ ভেঞ্চারস, ইটারেটিভ ও সেঞ্চুরি ওক ক্যাপিটাল। প্রি সিড রাউন্ডে গোযায়ানে বিনিয়োগ করেছে ব্র্যাক ওসাইরিস ইমপ্যাক্ট ভেঞ্চারস ও ওএস ভেঞ্চার।

সে সময় গোযায়ানের প্রতিষ্ঠাতা রিদওয়ান হাফিজ বলেছিলেন, ‘বর্তমানে মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ ফ্লাইটের টিকিট অনলাইনে বিক্রি হয়। আর ১ শতাংশ পর্যটক হোটেল বুকিং করেন অনলাইনে। ফলে সেখানে অনেক সম্ভাবনা আছে। আমরা আমাদের সেবার পরিধি বাড়াতেই বিদেশি বিনিয়োগের অর্থ ব্যয় করব।’

স্টার্টআপটির শুরুর গল্প

গত নভেম্বরে প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় ঠিক হলো অর্থনীতির অগ্রনায়কদের নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। এর পরের ধাপ ছিল তালিকা করে নাম বাছাই করা। অনেকবার কাটছাঁট করার পরে যে তালিকা চূড়ান্ত হয়, তাতে খুব সহজেই স্থান পেল গোযায়ানের রিদওয়ান হাফিজ। প্রথম আলোর অনুরোধে লেখাটি দিলেন প্রোটিন মার্কেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম। তিনি লিখলেন, রিদওয়ান হাফিজের স্বপ্নের শুরুটা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার সময় আহসানউল্লাহ হলে থাকতে। কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ার সময় পরিবারের কিছুটা দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে ভাবতে থাকেন কী করা যায়। দেখলেন দেশে ডেটা বা উপাত্ত নিয়ে কাজ হয় কম, উপাত্ত বিশ্লেষণ আরও কম। আহসানউল্লাহ হলের ৩৪৭ নম্বর রুম থেকে বন্ধু সুমিত সাহার সঙ্গে ১৩ বছর আগে শুরু করেন ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি ‘অ্যানালাইজেন বাংলাদেশ লিমিটেড’। এরই মধ্যে দেশের অন্যতম বড় ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের ছয়টি দেশে নিজেদের সম্প্রসারিত করেছে অ্যানালাইজেন বাংলাদেশ।

অ্যানালাইজেনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এই স্বপ্নবান তরুণ উদ্যোক্তা নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন নতুন উদ্যমে, নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে। দেশের পর্যটনশিল্পকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে গড়ে তোলেন ট্রাভেল টেক কোম্পানি ‘গোযায়ান’। যে দেশে একটি সফল উদ্যোগ গড়ে তোলা কষ্টের, সেখানে কেন নতুন প্রচেষ্টা? কাজের প্রয়োজনে প্রচুর দেশের বাইরে যাওয়া হতো রিদওয়ানের। সে সময়ই তিনি অনুভব করেন বিদেশভ্রমণে এ দেশের মানুষকে কী পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হয়। ভাড়ার বিষয়ে স্বচ্ছতা কিংবা দেশীয় ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে না পারার মতো খুঁটিনাটি অনেক বিষয় ভ্রমণকে জটিল করে তোলে। এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজিটালাইজেশনে পিছিয়ে থাকার মধ্যে নিজের সম্ভাবনার খোঁজ পান রিদওয়ান। এ নিয়ে বললেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেই সমস্যাগুলোর সমাধান দেওয়া সম্ভব। এ জন্যই এ নতুন ট্রাভেল টেক।’ ভাগনে যায়ানের আবদার মেটাতে তার নামেই ‘গোযায়ান’।

ঢাকা কার্যালয়ের কর্মীদের সঙ্গে গোযায়ানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিদওয়ান হাফিজ (পেছনে কালো শার্ট পরা)।

শুরুটা গল্পের মতো মনে হলেও যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না। ২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার পর শুধু পর্যালোচনা ও গবেষণায় চলে যায় এক বছর। নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণ শেষে ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। খুব কাছের কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে মূলধন জোগাড় করা হলেও শুরুতেই বোঝা গেল এ খাতে অবস্থান তৈরি করতে হলে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। এ সময় কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের চক্রান্তের শিকার হয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয়। তারপরও দমে যাননি রিদওয়ান ও তাঁর দল। এ কঠিন সময়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় দেশীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক-ওসিরিস ইম্প্যাক্ট ভেঞ্চার। প্রি-সিরিজ রাউন্ডের বিনিয়োগ দিয়ে শুরু হয় নতুন স্বপ্ন বোনার কাজ। দেশীয় প্রযুক্তিতে গড়ে উঠতে থাকে বিশ্বমানের অনলাইন ট্রাভেল প্ল্যাটফর্ম। সেরা মানের গ্রাহকসেবার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে গ্রাহকের জন্য আনতে থাকেন নানা রকম সুযোগ। এভাবে গ্রাহকের মন জয় করে ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা তৈরি হতে থাকে।

ঠিক সেই সময়েই ছন্দপতন। করোনা মহামারির কবলে পড়ে সারা বিশ্ব। বন্ধ হয়ে যায় আন্তদেশীয় বিমান যোগাযোগ। মুখ থুবড়ে পড়ে পর্যটনশিল্প। মাসের পর মাস বন্ধ রাখতে হয় সব কার্যক্রম। একপর্যায়ে খরচ কমাতে ছেড়ে দিতে হয় সুন্দর সাজানো অফিস। বিদায় জানাতে হয় অনেক কর্মীকে। হিসাবের খাতা যখন প্রায় শূন্যের কোঠায়, তখন কিছু নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নেন রিদওয়ান হাফিজ।
রিদওয়ান বুঝতে পেরেছিলেন পরিস্থিতি একদিন স্বাভাবিক হবে। ঘরবন্দী ভ্রমণপিপাসু মানুষ ছুটবে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে। তবে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের আগের অবস্থায় ফিরতে সময় লাগলেও আপাতত মানুষ ছুটবে দেশের ভেতরের পর্যটনকেন্দ্রে। গোযায়ান তাই তাদের সব শক্তি দিয়ে দেশীয় পর্যটন খাতকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে কাজ শুরু করে। করোনার বিধিনিষেধের মধ্যে যার যার বাসায় বসে কাজ করেই তৈরি করে বিশ্বমানের হোটেল ব্যবস্থাপনার সমাধান। সেটি বিনা মূল্যে সরবরাহ শুরু করে হোটেলগুলোতে। হোটেলগুলোও এগিয়ে এল নানা রকম অফার নিয়ে। দেশের পর্যটন এলাকাগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হতেই ঘুরে দাঁড়ায় গোযায়ান।

রিদওয়ান হাফিজ বললেন, ‘একটা স্বপ্নকে একা বড় করে তোলা যায় না। অনেক মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে। তাই আমি বিশ্বাস করি, নিজের স্বপ্নকে অনেকের মাঝে বপন করে দিতে পারাটাই একজন উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় সাফল্য।’
রিদওয়ান স্বপ্ন দেখেন, অচিরেই তিনি বাংলাদেশকে এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন। সেদিনের প্রত্যাশায় কাজ করে চলেছে রিদোয়ান ও তাঁর স্বপ্নের গোযায়ান।

Also Read: প্রযুক্তির পিঠে পর্যটনের উড়াল