৬টি চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কারখানাটির কাজ অর্ধেক কমে গেছে। তাতে প্রতিবছর লোকসান বাড়ছে। বকেয়া পড়েছে শ্রমিকের পাওনা।

টানা ১৫ বছর লাভ করেছে। কিন্তু তিন বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনছে। করোনার ধাক্কা ও ছয়টি চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যন্ত্রাংশ তৈরির ফরমাশ অর্ধেক কমে গেছে। এতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের চিনিকলের যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামতের একমাত্র কারখানা রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেড। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি এই কোম্পানিটির কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের দাবি, প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ জন্য তাঁরা কিছু সুপারিশও করেছেন।
কুষ্টিয়ার কমলাপুর এলাকায় গড়াই নদঘেঁষা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। ১৪০ বছরের পুরোনো এ প্রতিষ্ঠানটি দেশের চিনিকলগুলোর যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামত করে। ১৮৮১ সালে স্কটল্যান্ডের ডব্লিউ বি রেনউইক নাটোরের লক্ষ্মণহাটিতে আখমাড়াইকলের যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য রেনউইক অ্যান্ড কোম্পানি নামে কারখানা স্থাপন করেন। পরে সেই কারখানা কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। আর ১৮৯৬ সালে কুষ্টিয়ার বড় বাজার এলাকায় যজ্ঞেশ্বর নামে এক বাঙালি যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামে একই ধরনের আরেকটি কারখানা গড়ে তোলেন। ১৯৪৫ ও ১৯৬২ সালে দুবার হাতবদলের পর ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দুটি প্রতিষ্ঠানই ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে দুটি মিলই জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭৫ সালে মিল দুটি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত হয়। আর ১৯৭৯ সালে দুটি মিল একীভূত হয়ে প্রায় ৪০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠে রেনউইক, যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় দেশের চিনিকলের সব যন্ত্রাংশ আমদানি করা হতো। তাই চিনিকলের যন্ত্রাংশের আমদানির বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেনউইককে গড়ে তোলা হয়। কিন্তু দুই বছর আগে দেশের
১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি বন্ধ হয়ে গেলে কোম্পানিটির ব্যবসা হুমকিতে পড়ে। কর্মকর্তারা জানান, একসময় সারা বছরই রেনউইক কারখানা জমজমাট ছিল। সারা মাস কাজ চলত। এখন কাজ আগের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তাতে আয়ও কমেছে রেনউইকের।
২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত লাভেই চলছিল কারখানাটি। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৮৪ লাখ টাকা লাভ করে। তার আগের বছর লাভ করে ১ কোটি টাকার বেশি। এরপর থেকে লোকসান শুরু হয়। বিশেষ করে করোনা শুরুর পর থেকে লোকসানের পাল্লা ভারী হতে থাকে রেনউইকের। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা লোকসান করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৭ কোটি ৭৫ লাখে। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে বিক্রি হয়েছে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি।
প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আকুল হোসেন জানান, রেনউইকের কারখানায় চিনিকলে ব্যবহৃত ৩৫টি হালকা ও ভারী যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। ১৫টি চিনিকল চালু অবস্থায় বছরে ১৮ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ বিক্রির রেকর্ডও ছিল। এখন তা কমে ৭–৮ কোটি টাকায় নেমেছে।
এ কারণে লাভের জন্য বিকল্প উপায় খুঁজছে কোম্পানিটি। এ জন্য একটি টাস্কফোর্স কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া রেনউইকের অব্যবহৃত জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমেও আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
রেনউইকের শ্রমিকদের সংগঠন সিবিএ সভাপতি সেলিম রেজা বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বন্ধ। পদের তুলনায় লোকবল কম। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হচ্ছে কয়েক মাস পরপর। অনেকে দুই থেকে তিন বছর আগে অবসরে গিয়েও পাওনা পাচ্ছেন না। জানা গেছে, ২০১৫ সালের পর অবসরে যাওয়া ৪৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা পাওনা বকেয়া পড়েছে।
গত রোববার দুপুরে কারখানায় গিয়ে কথা হয় শ্রমিক ওবাইদুর রহমানের সঙ্গে। চাকরিজীবনের ৩৫ বছর কাটিয়েছেন এই কারখানায়। তিনি বলেন, এ দীর্ঘ চাকরিজীবনে কারখানার এমন নীরবতা আগে কখনো দেখেননি। ৪২ বছর ধরে এ কারখানায় কাজ করছেন মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, যন্ত্রাংশ তৈরির সবকিছুই আছে এ কারখানায়। শুধু কাজ নেই।
কোম্পানিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন চিনিকলের কাছে কোম্পানিটির ২২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। রেনউইকের আয়ের বড় উৎস ছিল আখ পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রলি বিক্রি। প্রতিবছর চিনিকলগুলোর কাছে ট্রলি বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির আয় হতো ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা। এ আয়ের পথটি এখন পুরোপুরি বন্ধ।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলেন, চিনিকল ছাড়াও সরকারের মালিকানাধীন সার কারখানাসহ নানা ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকার চাইলে এসব প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রাংশ তৈরির কিছু কাজ রেনউইককে দিতে পারে। কাজের ফরমাশ পেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কোম্পানিটি। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের অটো চালকল, কেব্ল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানার যন্ত্রপাতিও রেনউইক থেকে তৈরি করা যেতে পারে। সেটি হলে প্রতিষ্ঠানটিতে আবারও কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।
আর্থিক সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে কোম্পানিটির। ২০৮টি পদের বিপরীতে কর্মরত ১৬৬ জন।
কারখানার আয় বাড়াতে গড়াই নদের তীরে একটি পার্কও পরিচালনা করছে কোম্পানিটি। করোনার কারণে সেই পার্ক থেকেও আয় কমে গেছে। ২০১৯ সালে এ পার্ক থেকে ৪২ লাখ টাকা আয় হয়েছিল। করোনার কারণে তা কমে ২১ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। পার্কটিতে নতুন রাইড সংযোজনসহ আধুনিকায়নের মাধ্যমে দর্শনার্থী টানতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে চায় কোম্পানিটি। এ জন্য করপোরেশন থেকে অর্থ চাওয়া হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে রেনউইকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আল ওয়াদুদ আমিন বলেন, ‘আমরা এখন চেষ্টা করছি বিকল্প উপায়ে প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করার। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কিছু প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কয়েক বছরের মধ্যে আবার ঘুরে দাঁড়াবে রেনউইক।’